মানুষ কী চাহে? কী না থাকিলে মানুষ বাঁচিতে পারে না? মূলত দুইটি জিনিস না থাকিলে জীব প্রজাতির অস্তিত্ব বিলীন হইয়া যাইবে। ইহার একটি হইল খাদ্য, অন্যটি হইল রিপ্রোকাডশন, অর্থাৎ প্রজনন। মানুষ তো সৃষ্টির সেরা জীব। সুতরাং এই দুইটির পাশাপাশি মানুষ আরও একটি চাহে—তাহা হইল শান্তিতে বসবাস। বলা যায়, শান্তি ও স্বস্তিতে থাকিবার স্বার্থেই মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটিয়াছে। সিন্ধু সভ্যতা হইতে শুরু করিয়া মিশরীয়, সুমেরীয়, পারস্য, ব্যাবিলনীয়, রোমান প্রভৃতি সভ্যতার মূলে ছিল মানবজীবনে স্বস্তিদান করা। একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়া বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে উত্পাদন ও সম্পদ অর্জনের দিক দিয়া মানবজাতি আজ এমন এক অবস্থায় উন্নীত হইয়াছে যে, বিশ্বের ৭৫০ কোটি মানুষকে স্বস্তিদায়ক ও সম্মানজনক জীবন উপহার দেওয়া খুব কঠিন কাজ নহে। কারণ, বিশ্বব্যাপী উৎপাদন বাড়িতেছে, সম্পদ বাড়িতেছে, মাথাপিছু গড় আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়িতেছে। বলা যায়, সকল দেশেই কমবেশি বাড়িতেছে প্রাচুর্য ও ভোগবিলাস; কিন্তু এত প্রাচুর্যময় পৃথিবীতেও মানুষের মনে স্বস্তি নাই। শান্তি নাই। কেন? ঊনবিংশ শতাব্দীতেও একজন রাজা-বাদশা চাহিলেও আজিকার মতো ভোগবিলাস করিতে পারিত না। এখন ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন মেম্বারের বাড়িতেও এমন ব্যবস্থা থাকে, গরম লাগিলে এক সুইচেই ঠাণ্ডা হাওয়া, ঠাণ্ডা লাগিলে গরমের ব্যবস্থা। ভোগবিলাস খাদ্যখানায় বিচিত্র রেসিপি, যখন-তখন দেশবিদেশে বেড়াইতে যাওয়া—সকল কিছুই যেন আলাদিনের চেরাগের মতো, চাহিলেই পাওয়া যায়। এত কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু শান্তি কোথায়? কোথায় পালাইল শান্তি? শান্তি কি আসে? প্রখ্যাত কবি শহীদ কাদরী যেমন লিখিয়াছেন—‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...’।
কেন শান্তি পাইবে না? আসলে শান্তি হইল দুইটি বিষয়ের সমন্বয়। উহার একটি হইল—নিরাপত্তা, অন্যটি হইল আমাদের মানসিক দিক। ইংরেজিতে ইহাকে বলা হয়—পিস অব মাইন্ড ইজ এ মেন্টাল স্টেট অব কামনেস অর ট্রাংকুয়িলিটি। ইহা হইল উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা হইতে মুক্তি পাওয়া; কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হইতে মুক্তি পাইতে হইলে নির্জন বনে গিয়া বসবাস করিতে হইবে। আরণ্যিক যুগের সেই অরণ্যও নাই, সেই নির্জনতাও নাই। আমাদের চারিদিকে ছায়াযুদ্ধ, শীতল যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জটিল পরিস্থিতি। কথিত উদার গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ইত্যাদির ভিতর দিয়াই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিচিত্র ধরনের যুদ্ধাবস্থা দেখা যাইতেছে। অথচ যেই সকল কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাহা করিতে মহান সৃষ্টিকর্তা নিষেধ করিয়াছেন। পবিত্র কুরআন শরিফে বলা হইয়াছে—‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কোরো না।’ (সুরা-২ আল-বাকারা, আয়াত :১১)।
স্পষ্ট কথা হইল—মানুষ গণতন্ত্র বোঝে না, শান্তি বোঝে। মানুষ শান্তিতে ঘুমাইতে চাহে। নিরাপত্তার সহিত নিশ্চিন্তে বসবাস করিতে চাহে। কাণ্ডারি হুঁশিয়ার কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলিয়াছেন—‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ’। সন্তরণ অর্থাৎ সাঁতার না জানিয়া আমরা স্বখাদ সলিলে ডুবিতেছি। তাহা হইলে উপায়? ইংরেজিতে একটি কথা আছে—ওয়ার ফর পিস। অর্থাৎ শান্তির জন্য যুদ্ধ; কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর শান্তির অহিংস বাণী এইভাবেও শুনাইয়াছেন যে—‘চোখের বদলা লইতে অন্যের চোখ উপড়াইয়া লইলে একসময় সমগ্র পৃথিবী অন্ধ হইয়া যাইবে।’ সেই ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করিতে হয় রোনাল্ড রিগানের কথা—‘শান্তি মানে সংঘাতের অনুপস্থিতি নহে, ইহা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত পরিচালনা করিবার ক্ষমতা।’ জটিল কথা। যেমনটি বলিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যায়কে সহ্য না-করিবার কথা। তিনি আরেকটি কবিতায় বলিয়াছেন—‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস—।’
সত্যিই কি শান্তির ললিত বাণী ব্যর্থ পরিহাসের মতো শুনাইবে? ইহার চাইতে পরিতাপের কথা আর কী হইতে পারে? সুতরাং কবির কণ্ঠে আমরাও বলিতে চাই—‘বিদায় নেবার আগে তাই/ ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/ প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’