হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের গুদামের লকার হইতে চুরি হইয়াছে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি সোনা। ঘটনাটি লইয়া সমগ্র দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হইয়াছে। চুরি হওয়া এই সোনার মূল্য যাহাই হউক না কেন, একটি স্পর্শকাতর স্থান তথা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগ হইতে ইহা খোয়া গিয়াছে। এই জন্য এই বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখিবার কোনো অবকাশ নাই। ইহাতে বাংলাদেশের রাজস্ব বিভাগ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, তেমনি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হইতেছে। এনবিআর ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে না জানাইয়া এই বিপুল সোনা ভল্টে রাখা লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে। বিমানবন্দর হইতে উদ্ধারকৃত সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়ার যে বিধান রহিয়াছে, তাহাও এখানে যথাযথভাবে পালিত হয় নাই। এই ঘটনায় চার জন সিপাহিসহ আট জনকে পুলিশ গ্রেফতার করিয়াছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিয়ম না মানা ও দায়িত্ব অবহেলার কারণেই যে এমন চুরির ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। যেইখানে চার জনের স্বাক্ষরের পর ভল্ট খুলিবার অনুমতি মিলে এবং জব্দকৃত সোনার তালিকা ঠিক আছে কি না, তাহা নিয়মিত তদারকির বিধান রহিয়াছে, সেইখানে কীভাবে এমন চুরির ঘটনা ঘটিতে পারে?
বাংলায় একটি প্রবাদ রহিয়াছে, বেড়ায় খেত খায়। আবার সরিষার মধ্যে ভূত থাকিবার কথাও আমাদের অজানা নহে। এই সকল কারণে দেশে একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটিয়া চলিয়াছে। এই পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম দায়িত্বহীনতাই দায়ী। দেশের উন্নয়ন টিকসই করিতে হইলে সর্বত্র দায়দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠিত না হইলে কোনো দেশ উন্নতি লাভ করিতে পারে না। শুধু কাস্টমস বিভাগ নহে, সরকারের সকল বিভাগে দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। আবার শুধু সোনার ক্ষেত্রেও নহে, রাষ্ট্রের যে কোনো সম্পদ সংরক্ষণে আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান হইতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করিতে হইবে। এই সরকার গত দেড় দশক ধরিয়া ক্ষমতায় রহিয়াছে। প্রথম দিকে কয়েক বত্সর এমনকি একটি মেয়াদ শেষ হইয়া যাইবার পরও দেখা যায়, সরকারি ওয়েবসাইটগুলি হালনাগাদ করা হয় নাই। ওয়েবসাইটে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখানো হইতেছে। ইহা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর চরম দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। পরে অবশ্য তাহা সংশোধন করিয়া তত্স্থলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নাম ও ছবি ব্যবহার করা হইয়াছে। এইরূপ নানা দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ থাকিবার পরও সুনাম ও সুখ্যাতি ক্ষুণ্ন হইতেছে।
আমরা জানি, ইসলামের দৃষ্টিতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা একটি পবিত্র আমানত। ইহার অন্যথা তাহা দুর্নীতি, আমানতের খেয়ানত ও বিশ্বাস ভঙ্গের কাজ। এই সম্পর্কে মহানবি (স.) চমত্কারভাবে বলিয়াছেন, ‘আলা কুল্লুকুম রয়িন ওয়া কুল্লুকুম মাসউলুন আন রয়িইয়াতিহি।’ অর্থাত্ সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবে। (বুখারি) তাহার মানে পরকালে জবাবদিহিতা করিতে হইবে। অনুরূপভাবে ইহকালেও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক দেশে এই জবাবদিহিতা ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র চলিতে পারে না। ইহার অভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়া পড়ে অন্যায়, অবিচার ও অনিয়ম। তাই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাহা ঘটিয়াছে, সেই ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করিতে পারিলে তাহা অন্যদের জন্যও হইবে দৃষ্টান্তমূলক ও শিক্ষণীয়। যাহারা এই বিষয়টি তদন্ত করিতেছেন, তাহাদেরও হইতে হইবে পূর্ণ দায়িত্বশীল। কর্তব্যপরায়ণতা ও দায়িত্ববোধের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে গড়িয়া উঠুক সতর্কতা ও সচেতনতা। মনে রাখিতে হইবে, দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা ও অমনোযোগিতা ডাকিয়া আনে নানা ধরনের বিপদ, ব্যর্থতা ও বিপর্যয়। আর প্রতিটি মানুষ যদি নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে দায়িত্ব সচেতন থাকেন এবং নিজের কাজটুকু ঠিকমতো সম্পন্ন করেন, তাহা হইলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি হইবে অপ্রতিরোধ্য। দেশ ও জাতি হইবে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী।