‘ব্রেইন-ড্রেইন’ বহু বত্সর ধরিয়া আলোচিত যুগলবন্দি একটি শব্দ। তৃতীয় বিশ্বের মেধাবী, দক্ষ এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা কেন তাহাদের দেশ হইতে তুলনামূলক উন্নত দেশে অভিবাসন করিতে চাহেন, তাহা লইয়া অনেক গবেষণা হইয়াছে। এখনও হইতেছে। প্রকৃতপক্ষে যে কোনো ধরনের অভিবাসনের মধ্যেই নূতনতর সুযোগ-সুবিধা ও আরও ভালো থাকিবার অভিলাষ থাকে। ইহা হইল উইলফুল থিংকিং—যাহাতে দক্ষ, মেধাবী ব্যক্তির মনে হয়, তিনি যেইখানে রহিয়াছেন, সেইখানে তাহার মেধা ও দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন হইতেছে না এবং ভবিষ্যতেও তাহার সম্ভাবনা কম। সুতরাং তিনি বিকল্প জায়গা খোঁজেন, যেইখানে গিয়া তিনি নিজের মেধা ও দক্ষতাকে আরও ভালোমতো কাজে লাগাইতে পারিবেন। এইজন্য আমরা দেখিতে পাই অভিবাসনের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। মাত্র কয়েক শতক পূর্বেও ইউরোপের স্বাধীনচেতা, মেধাবী, দক্ষ ও শিক্ষিতরা আমেরিকায় ছুটিয়া যাইত মুক্তচিন্তার মতপ্রকাশ ও আরও উন্নত জীবনের আশায়। বলা যায়, কয়েক শতক ধরিয়া যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ তৈরিই হইয়াছে ইউরোপের উচ্চভিলাষী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অমিয় প্রাণ ও সৃজনশীল শিক্ষিত মেধাবীদের দ্বারা। আর বর্তমানে তৃতীয় তথা, স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষিত, দক্ষ ও মেধাবীরা উন্নত দেশে যাইতে চাহেন মূলত অনেকগুলি কারণে।
এই ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ যেই কারণে ঘটে তাহার মধ্যে অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা। উন্নত দেশগুলিতে উচ্চ মজুরি, ভালো কাজের সুযোগ মেধাবীদের হাতছানি দেয়। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি এবং সশস্ত্র সংঘাতের আশঙ্কা এমন একটি পরিবেশ বিদ্যমান থাকে—যাহা পেশাদার বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য উপযোগী নহে। তাহা ছাড়া উন্নত দেশগুলিতে প্রায়শই সুপ্রতিষ্ঠিত গবেষণা এবং উন্নত অবকাঠামো থাকে—যাহা বিজ্ঞানী, গবেষক এবং শিক্ষাবিদদের আকর্ষণ করিয়া থাকে। যাহারা এই ক্ষেত্রগুলিতে তাহাদের ক্যারিয়ার আগাইয়া লইতে চাহেন তাহাদের জন্য বিকল্প আর কী রহিয়াছে? আধুনিক শিক্ষার মান এবং প্রযুক্তির অ্যাক্সেস ও সার্বিক পরিবেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট কম। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলি সাধারণত উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, পরিষেবা, উন্নত জীবনযাত্রার মান এবং উচ্চতর জীবনযাত্রার সুযোগ করিয়া দেয়।
প্রতিটি মেধাবী, শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষই তাহার পরিবার লইয়া একটি নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ চাহেন। ইহার সঙ্গে চাহে তাহার পরবর্তী প্রজন্ম বাড়িয়া উঠুক উন্নত শিক্ষা-চিকিত্সা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসনের মধ্যে। উন্নত দেশগুলিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং সমতাসহ বৃহত্তর রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতাও মেধাবীদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। ফলে ‘ব্রেইন-ড্রেইন’-এর ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে।
ইহা ঠিক যে, ‘ব্রেইন-ড্রেইন’-এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সাময়িক কিছু সুবিধা পায়। যেমন যাহারা দেশের বাহিরে যায়, তাহারা দেশে অবস্থিত পরিবারের জন্য রেমিট্যান্স পাঠায়। ইহা স্থানীয় অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করিতে সহায়তা করে। কিন্তু ইহা চলে প্রথম প্রজন্ম পর্যন্ত। অদক্ষ শ্রমিকদের কোনো উন্নত দেশ সাধারণত নাগরিকত্ব দিতে চাহে না। বেশির ভাগ উন্নত দেশের অভিবাসন নীতি সেইভাবেই তৈরি। কিন্তু দক্ষ, মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিতদের প্রয়োজন সব উন্নত দেশেই। ইহা যেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণিকার কবিতার মতো—‘কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,/ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।/হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা—/কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!’ এইখানে উন্নত বিশ্ব হইল কেরোসিনের শিখা, আর মাটির প্রদীপ হইল অদক্ষ অশিক্ষিত শ্রমিক। অন্যদিকে আকাশের চাঁদ হইল দক্ষ মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। সুতরাং গগনেতে চাঁদ উঠিলে তাহাকে তো সকলেই চাহিবে। তৃতীয় বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের মনে রাখিতে হইবে, ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ হইলে তাহাদের লাভ মাত্র একটি প্রজন্ম মাত্র। যাহারা উন্নত দেশে চলিয়া যায়, তাহাদের বেশির ভাগেরই দ্বিতীয় প্রজন্মের পর নিজ দেশে আর টাকা পাঠাইতে হয় না। তাহারা বিদেশেই স্থায়ী হইয়া যান। সুতরাং যেই যেই কারণে ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ হইতেছে, সেই সমস্যাগুলি দূর করিতে হইবে।