বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?

আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৩১

একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য চারটি মৌলিক উপাদান থাকা আবশ্যক। জনগণ, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব। এই চারটির মধ্যে যে কোনো একটি অনুপস্থিত থাকিলে কোনো রাষ্ট্রই আর রাষ্ট্র বলিয়া গণ্য হইবে না। ইহার মধ্যে আবার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হইল জনগণ। জনগণের থাকিবার জন্য ভূখণ্ড, জনগণকে সুশৃঙ্খল রাখিতে সরকার এবং জনগণের নিরাপত্তার জন্য সার্বভৌমত্ব। অর্থাত্ রাষ্ট্রের সমস্ত কার্যক্রম তাহার জনগণকে কেন্দ্র করিয়া হইয়া থাকে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে গঠিত হইয়াছে ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের জনগণ রহিয়াছে, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রহিয়াছে, জনগণকে শৃঙ্খলার সহিত শাসন করিবার জন্য রহিয়াছে সরকার। এই সরকার গঠিত হয় রাজনৈতিক দল লইয়া। এই রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হইল সংঘবদ্ধভাবে সরকার গঠন করিয়া জনগণের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কাজ করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বায়ান্ন বত্সর পার হইয়া গিয়াছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থে নিজেদের কতটুকু বিলাইয়া দিয়াছে, সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা প্রদানে কতটুকু সাফল্য অর্জন করিতে পারিয়াছে, সেই প্রশ্ন থাকিয়াই যায়।

গতকাল ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জে একটি রাজনৈতিক দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষকালে সাত মাস বয়সি তাবাসসুম গুলিবিদ্ধ হইয়া বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যালের ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিত্সাধীন রহিয়াছে। ইহার পূর্বে ২০১০ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সরকারি দলের সমর্থক ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের সাধারণ ছাত্র আবু বকর ক্রসফায়ারে গুলিবিদ্ধ হইয়া পরের দিন মারা যান। ২০০২ সালে তত্কালীন সরকারি দলের দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধের মধ্যখানে পড়িয়া নিহত হন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। ইহা ছাড়া প্রায়শই একাধিক রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের মধ্যে পড়িয়া অপ্রত্যাশিতভাবে সাধারণ মানুষের হতাহত হইবার ঘটনা পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। যেই রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য হইল দেশের জনগণকে সুশৃঙ্খল রাখা, দেশের জনগণের নিরাপত্তা প্রদান করা, সেই রাজনৈতিক দলের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের সংঘর্ষ এবং দলীয় কোন্দলের কারণে সাধারণ জনগণ হতাহত হইতেছেন, যাহা কাম্য নহে। এই যে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগণ তাহাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা পাইতেছেন না, ইহার পিছনে কী কারণ থাকিতে পারে?

দার্শনিক রুশো তাহার বিখ্যাত সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট গ্রন্থে বলিয়াছেন, একটি রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থা হইল তাহার জনগণ ও সরকারের মধ্যে একধরনের চুক্তি। সাধারণ জনগণ সরকারের নিকট তাহাদের ইচ্ছা সমর্পণ করিবেন, বিনিময়ে সরকার তাহাদের সামাজিক সেবা ও নিরাপত্তা প্রদান করিবে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু স্বাধীনতা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের নিকট তাহাদের ইচ্ছা সমর্পণ করিয়াছে, সেইহেতু রাষ্ট্রের উচিত জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করিতে নিরলস কাজ করিয়া যাওয়া; কিন্তু জনগণ তাহাদের কাঙ্ক্ষিত পূর্ণ নিরাপত্তার সুবিধা কি ভোগ করিতে পারিতেছে? বাংলাদেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল জনগণের নিরাপত্তার চাইতে নিজেদের নিরাপত্তার উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করিতেছে বলিয়া জনমনে যে প্রশ্ন ও সন্দেহ রহিয়াছে, তাহার কি অবসান হইবে না?

রুশোর চুক্তি অনুযায়ী জনগণের নিকট হইতে রাষ্ট্র ট্যাক্সসহ যাহা চাহিতেছে তাহা সবই তো বাংলাদেশের জনগণ দিতেছে, তাহার পরও জনগণ রাষ্ট্রের নিকট হইতে যাহা চায় ও পাওয়ার অধিকার রাখে, তাহা পরিপূর্ণভাবে পাইতেছে না কেন? এই না পাওয়ার ব্যাপারটা অতি দুঃখজনক। কারণ বাংলাদেশ সরকার জনগণের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেছে; কিন্তু একশ্রেণির রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তার কারণে জনগণ তাহা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করিতে পারিতেছে না। উক্ত সমস্যা হইতে পরিত্রাণ পাইতে হইলে সাধারণ জনগণকেই অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সদা সজাগ ও সতর্ক থাকিতে হইবে। পরিশেষে, মুন্সীগঞ্জের এই ঘটনায় যাহারা দোষী, তাহাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে বলিয়া আমরা আশা করি।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন