পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশের একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি একজন সাবেক কূটনীতিবিদ ও আমলাও। তিনি কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর মহাপরিচালক। তিনি জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের ছিলেন ইকোনমিক মিনিস্টার। ২০০৩ সালে অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন বা বিসিকের চেয়ারম্যান হিসাবে অবসর গ্রহণের পর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। তিনি তিনটি মন্ত্রণালয় তথা জনপ্রশাসন, অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এই বিশেষ অভিজ্ঞতার কারণে তিনি যখন কোনো কথাবার্তা বলেন, তখন তাহা সংগত কারণে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাহার কোনো কোনো বক্তব্য জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য, চিত্তাকর্ষক ও ব্যতিক্রমী হিসাবে বিবেচিত হয়।
প্রসঙ্গত পরিকল্পনামন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে। এই বত্সর জাতীয় একটি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বলেন যে, পুলিশি অস্ত্র দিয়া মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করিলে লাভ হইবে না, বরং ক্ষতি হইবে। কাজের প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের যে ভালোবাসা বা প্রতিশ্রুতি থাকিবার কথা, তাহা নাই। আমাদের আইএমইডি আছে, যাহারা প্রকল্প নজরদারি করে; কিন্তু সরকারি এই প্রতিষ্ঠান ঠুঁটো জগন্নাথ। রাজনীতির মাঠ দখল লইয়া পালটাপালটি সমাবেশ-মহাসমাবেশের দিকে ইঙ্গিত করিয়া তিনি বলেন যে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাস্তার সংঘাত এড়াইতে সংলাপেই সমাধান খুঁজিতে হইবে। যদিও সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা সংলাপের প্রয়োজনীয়তাকে নাকচ করিয়া দিয়াছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকায় রাজনৈতিক কার্টুন কম দেখা যায়, এই সত্য উচ্চারণও তাহারই। অথচ পশ্চিমা বিশ্বে এইরূপ কার্টুনের বিশাল ভূমিকা রহিয়াছে। অন্যদিকে লক্ষ-কোটি টাকা দিয়া আমরা কী কাজ করিতেছি ও কেন করিতেছি, সেই টাকার মালিক জনগণের তাহা জানিবার অধিকার ও প্রয়োজন রহিয়াছে বলিয়া তিনি মনে করেন। হাওরে সড়ক বানাইয়া আমরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারিতেছি—এমন মন্তব্যও তাহার। আবার একজন সাবেক আমলা হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিবিদদের উপর আমলাদের খবরদারির বিরোধী তিনি। তাহার মতে, ‘স্থানীয় সরকারের প্রাণভোমরা এখন আমলাদের কাছে। আমলারা স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধেদের গলায় রশি বেঁধে ঘোরান’। বিভিন্ন সময় তাহার এই সকল সত্য ও অকপট উচ্চারণ জনগণের নিকট প্রশংসিত হইয়াছে।
ইহারই ধারাবাহিকতায় তিনি গত রবিবার মহান জাতীয় সংসদে বলিয়াছেন, ‘দুর্নীতি বেড়েছে। এ বিষয়ে সংসদ সদস্যরা একমত, আমিও তাদের সঙ্গে একমত। সারা দেশে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা আগের তুলনায় বেড়েছে। তুলনা বলতে আনুপাতিক হারে। যে পরিমাণ পাবলিক মানি ৩০-৪০ বছর আগে ব্যয় হতো, তার তুলনায় ২/৩/৪ গুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। ফলে সুযোগ-সুবিধা, চুরির সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে আমি বলব। এটা জাতীয় সমস্যা।’ এই ক্ষেত্রে তিনি অসত্য ও ক্ষতিকর কিছু বলেন নাই। অর্থাৎ অতীত সরকারের আমলেও দুর্নীতি ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকিবে। এখন ইহার মাত্রা কতটা কমাইয়া আনা যায় সেই চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। দুঃখজনক হইলেও সত্য, ই-টেন্ডারিংয়ের পরও দুর্নীতি কমে নাই। বরং এমন অভিযোগও রহিয়াছে যে, ক্ষেত্রবিশেষে পূর্বে যেইখানে ১০-২০ শতাংশ দুর্নীতি হইত, এখন সেইখানে সেই পরিমাণ কাজ হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ ছাড়াই বিল উঠাইয়া লওয়ারও নজির রহিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুগোপযোগী আইনকানুন প্রণয়ন, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্নীতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যে দায় নাই, তাহা নহে।