পৃথিবীর প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীরা যুগে যুগে বলিয়া গিয়াছেন—নির্বোধ থাকিয়ো না। চিন্তা করো। নিজের ভিতরে খুঁড়িয়া দেখো—কে তুমি? বিশ্লেষণ করো নিজেকে। মূলে যাও, উৎস যাও। পরিস্থিতির ওজন না বুঝিয়া যাহা খুশি বলিয়ো না। যাহা কিছু চাহিয়ো না। চিন্তা করো। ভাবো, আরও আরও ভাবো। গভীরভাবে আত্মবিশ্লেষণ করো। পরিস্থিতিকে সন্ধিবিচ্ছেদ করো। বুঝিয়া দেখো—যাহা চাহিতেছ, তাহা কেন চাহিতেছ? কেবল চাহিতে হইবে বলিয়া কি চাহিতেছ? যাহা করিতেছ, তাহা কি ঠিক করিতেছ? এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া তাহার পর পদক্ষেপ ফেলো। নইলে পদচ্যুতি ঘটিবে, পতন ঘটিবে। গর্তে পড়িবার পূর্বে বরং ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না।
ইহা অতি সহজ কথা। আবার ইহাই অতি কঠিন কথা। অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া হয়তো পাইপলাইনে থাকিবার জন্য লম্ফ দিয়া পাইপের মধ্যে অনেকে ঢুকিয়া পড়িতে চাহেন। কিন্তু প্রয়োজন না থাকিলেও যদি কেহ পাইপলাইনে ঢুকিয়া পড়েন, তবে তিনি সেই পাইপলাইনে জ্যাম তৈরি করেন। সমস্যা তৈরি করেন। বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন। সুতরাং মনীষীদের কথা নিভৃতে চোখ বন্ধ করিয়া ভাবিয়া দেখিতে হইবে। বারবার ভাবিয়া দেখিতে হইবে। কেন মনীষীরা বলিয়াছেন নিজেকে বিশ্লেষণ করিতে? কেন নিজের ওজন বুঝিয়া লইতে বলিয়াছেন? কেন বলিয়াছেন—ভাবো, গভীরভাবে আত্মবিশ্লেষণ করো? কেন কেন কেন? কারণ, চিন্তা না করিতে পারিলে, নিজেকে এবং নিজের ওজন না জানিতে পারিলে বিপদে পড়িতেই হইবে। সুতরাং বিপদে যাহাতে না পড়িতে হয়, সেই জন্যই চিন্তা করিয়া পা ফেলিতে হইবে। সেই জন্যই কোনো কাজ করিবার পূর্বে গভীরভাবে ভাবিতে হইবে।
কিন্তু সকলের কি ভাবিবার ক্ষমতা থাকে? থাকে না। আসলে বেশির ভাগ মানুষই খুব বেশি ‘চিন্তা’ করিবার ধীশক্তি রাখেই না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করিবার যোগ্যতা রহিয়াছে খুব কম মানুষের। এই জন্যই দার্শনিক ভলতেয়ার বলিয়াছেন—‘একজন মানুষকে উত্তরের চাইতে তাহার প্রশ্ন দ্বারা বিচার করো।’ কারণ প্রশ্ন করিতে হইলে চিন্তাভাবনা করিতে হয়। চিন্তাভাবনা করা তো এত সহজ নহে। সেই পরিসংখ্যান তুলিয়া ধরিয়াছেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। তিনি মনে করিতেন—‘৫ শতাংশ মানুষ চিন্তা করিতে পারেন। ১০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে, তাহারা চিন্তাভাবনা করিবার ক্ষমতা রাখেন। অন্যদিকে ৮৫ শতাংশ মানুষ যেন পণ করিয়াছে তাহারা বরং মারা যাইবেন তবু কষ্ট করিয়া চিন্তাভাবনার ধার ধারিবেন না।’ সম্ভবত এই সিংহভাগ মানুষের মনের কথা পড়িতে পারিয়াছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর চীনা দার্শনিক লাইওস। তিনি বলিয়াছেন—‘অত চিন্তাভাবনার কী আছে? চিন্তা বন্ধ করুন, দেখিবেন আপনার সমস্যাগুলিও উধাও হইয়া গিয়াছে।’ কথাটি তিনি ব্যঙ্গার্থে বলিয়াছিলেন। কারণ আমরা ‘চিন্তা’ করিতে পারি বলেই আমাদের অস্তিত্ব আছে। সুতরাং—চিন্তা না করিতে পারিলে নিজের অস্তিত্ব লইয়াই টানাটানি পড়িবে।
কিন্তু যাহারা টমাস আলভা এডিসনের ভাবনা অনুযায়ী চিন্তা করিতেই ভয় পায়—তাহাদের কী হইবে? তাহারা আসলে অবোধ শিশু। যেই শিশু জানে না—আগুনের শিখায় হাত দিলে হাত পুড়িবে—সে তো আগুনের উজ্জ্বল জ্যোতি দেখিয়া তাহা ধরিতে ব্যাকুল হইবেই। হাত না পোড়া পর্যন্ত সেই শিশুকে কিছুতেই সেই আগুনের আকর্ষণ হইতে রোখা যাইবে না। আবার কেহ কেহ আছেন যাহারা অভ্যাস-দোষে আক্রান্ত। সেই যে প্রবাদে বলা হইয়াছে—‘অভ্যাস দোষ না ছাড়ে চোরে,/ শূন্য ভিটায় মাটি খোঁড়ে।’ সুতরাং নিজেকে চিনিতে হইবে। বুঝিতে হইবে নিজের ওজন। আত্মবিশ্লেষণ করিয়া দূর করিতে হইবে অভ্যাস-দোষ। কাজ করিতে হইবে বুঝিয়া এবং ভাবিয়া। না বুঝিয়া পা ফেলিলে কখনো না কখনো পদচ্যুতি ঘটিবেই।