মরক্কো ট্র্যাজেডির রেশ কাটিতে না কাটিতেই নূতন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছড়াইয়া পড়িল আফ্রিকার আরেক দেশ লিবিয়ায়। ভূমিকম্পবিধ্বস্ত হাজার হাজার স্বজনহারা মরক্কান যখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন যাপন করিতেছে, ঠিক সেই সময়ে পূর্ব লিবিয়ায় সুনামিসদৃশ্য অকস্মাত্ বন্যা ভাসাইয়া লইয়া গেল কয়েক হাজার তাজা প্রাণ। গত সোমবার ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের প্রভাবে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত হয় এবং এই বৃষ্টির পানির চাপে ওয়াদি দারনা নামক নদীর উপরে অবস্থিত দুইটি বাঁধ ধসিয়া পড়ে। আর সেই বাঁধভাঙা পানিই কাল হইয়া উঠে সংশ্লিষ্ট লোকালয়ের জন্য! বাঁধের পানির তোড়ে সৃষ্ট বন্যা হাজার হাজার মানুষকে সমুদ্রের দিকে ভাসাইয়া লইয়া যায়। চোখের নিমেষে নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় আশপাশের বহু এলাকা। গণমাধ্যম হইতে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ৫ হাজারের অধিক মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন এই দুর্যোগে; নিখোঁজ রহিয়াছেন ১০ সহস্রাধিক লিবিয়ান। প্রলয়ংকারী এই বন্যায় হতাহতের শিকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই আমরা।
একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক, মানবসভ্যতা যতই সামনের দিকে আগাইয়া যাইতেছে, সমান তালে বৃদ্ধি পাইতেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। বিগত কয়েক যুগ ধরিয়া এমন সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ‘অসহায় সাক্ষী’ হইতেছি আমরা, যাহা বিশ্ববাসীর জন্য বড় অশনিসংকেত নিঃসন্দেহে। ঘনঘন ভূমিকম্প সংঘটিত হইতেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। বন্যা-সুনামি একদিকে ডুবাইয়া মারিতেছে তো, পৃথিবীর আরেক প্রান্তকে ভস্মীভূত করিতেছে আগুনের লেলিহান শিখা। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক কাল জুড়িয়া যেই রূপ ভয়াল দাবানলের প্রকোপ লক্ষ করা যাইতেছে, তাহাতে বলিতে হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন চতুর্দিক হইতে ক্রমশ ঘিরিয়া ফেলিতেছে ভূপৃষ্ঠকে! বৃহত্ নদনদীর পানি নামিয়া যাইতেছে; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়া যাইতেছে অস্বাভাবিক গতিতে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, ভূমিকম্প, ভূমিধস, নদীভাঙন, আর্সেনিক দূষণ, সিংকহোল, দাবানল, তুষারঝড়—কী না দেখিতেছে আজিকার বিশ্ব! ইহার ফলে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরিতেছে; ভাঙিয়া পড়িতেছে আর্থসামাজিক কাঠামো। আর্থিক ক্ষতি তো হইতেছেই, ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করিতেছে রোগবালাই। ইহাকে বরাবরই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষফল বলিয়া অবিহিত করিতেছি আমরা। দুঃখজনক ইইলেও সত্য, এই জন্য সকলের পূর্বে দায়ী আমরা নিজেরাই!
এককালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উঠিলেই চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিত বাংলাদেশের নাম। বস্তুত, জন্মলগ্ন হইতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের বড় ভুক্তভোগী এই জনপদ। তবে সাম্প্রতিক বত্সরগুলিতে দুর্যোগ কেবল বাংলা ভূখণ্ডকেই গ্রাস করিতেছে না, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জাঁতাকলে পিষ্ট হইতে দেখা যাইতেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলকে। এই বিচারে ‘আমরা তুলনামূলক ভালো আছি’ বলিতে হইবে! কিছুদিন পূর্বে পার্শ্ববর্তী ভারতে স্মরণকালের প্রবল বন্যা আঘাত হানিতে দেখিয়াছি আমরা। বন্যার জলে তলাইয়া যাইতে দেখিয়াছি পাকিস্তান, চীনসহ আরো কিছু দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। বন্যাকবলিত হইয়া বাংলাদেশের গোটা একটি বিভাগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে গত বত্সর, যাহাতে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি নামিয়া আসিয়াছিল জনজীবনে। স্বস্তির কথা, এই বত্সর দেশে বন্যার আশঙ্কা ছিল বটে; কিন্তু বানের ঘোলাজল বড় ধরনের তাণ্ডব চালায় নাই এইবারের বর্ষায়। ইহা মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা। দ্বিমত থাকিবার কথা নয়, দেশব্যাপী অবকাঠামো নির্মাণে বর্তমান সরকার বড় ধরনের সাফল্য দেখাইয়াছে। সড়ক-রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট নির্মাণসহ কানেকটিভিটির প্রশ্নে আমরা যেইভাবে আগাইয়া গিয়াছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবা হইতে বাঁচিতে তাহা আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ’ বাংলাদেশের জন্য ইহা পরম স্বস্তির বিষয় বইকি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাহারো হাত নাই—এই কথা যেমন সত্য, সতর্কতার মার নাই—ইহাও বাস্তব কথা। সুতরাং, প্রাকৃতিক দুর্যোগের করাল গ্রাস হইতে বাঁচিতে ‘অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড’ এড়াইয়া চলিতে হইবে। প্রকৃতির প্রতি করিতে হইবে সদয় আচরণ। বিশ্বের কতিপয় ধনী রাষ্ট্রকে—দখল-দূষণের বশবর্তী হইয়া যাহারা পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট করিবার জন্য অধিক দায়ী—দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে হইবে। বিশেষত, ভুক্তভোগী উন্নয়নশীল বিশ্বকে বাঁচাইতে প্রতিশ্রুত জলবায়ু তহবিল (ক্লাইমেট ফান্ডিং) কী করিয়া সচল-সবল রাখা যায়, সেই বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নাই। আশঙ্কাবার্তা রহিয়াছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটিয়া নিকট ভবিষ্যতে পানির নিচে তলাইয়া যাইবে বাংলাদেশ—ইহা আমাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ স্বভাবতই। এমতাবস্থায়, সকলের দায়িত্বশীল ভূমিকায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল প্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালো থাবা হইতে রক্ষা পাইবে—ইহাই প্রত্যাশা।