সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কেন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৩০

বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো ইনস্টিটিউটের কাজ হলো শিক্ষা ও মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি সরকারের পলিসি বাস্তবায়নে সহায়তামূলক প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করা। ইনস্টিটিউটগুলো সেই সম্ভাব্য প্রতিবেদন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সরকার আন্তরিকভাবেই চাইছে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসুক। সরকারের এই উদ্যোগে নীতি বাস্তবায়নে গবেষণা সহায়তা প্রদান করে আসছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)। ২০০২ সালে প্রাথমিকভাবে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর মূল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালে। সেই থেকে আমরা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে আসছি।

সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হলো তা বের করা। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর দেশের মোট জিডিপির ১ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতি হয়। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে আমরা প্রতি বছর একটি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারি। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা গেলে সেই পরিবার কার্যত নিঃস্ব হয়ে যায়। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, পরিবারের সবচেয়ে সচল ও কর্মক্ষম মানুষটিই বেশি মুভমেন্টের মধ্যে থাকেন। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম মানুষটিই যদি চলে যান, তাহলে পরিবারের ওপর যে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে, তা কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। কারণ মানুষের জীবনের কোনো বিনিময়মূল্য হয় না।

এখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রতিদিন কতসংখ্যক মানুষ মারা যায়, তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। তবে একে চূড়ান্ত পরিসংখ্যান বলা যাবে না। কারণ দুর্ঘটনার অনেক সংবাদই মানুষের অগোচরে থেকে যায়। অনেকেই আইআরএপি (ইন্টারন্যাশনাল রোড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম) পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক সময় দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি নিরুপণ করে থাকেন। এটা উন্নত বিশ্বের পদ্ধতি। আমাদের দেশে এখনো এসংক্রান্ত কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়নি। দুর্ঘটনায় যে মানুষটি মারা যায়, তার সঙ্গে অনেকগুলো পরিবার যুক্ত বা নির্ভরশীল থাকতে পারে। তাই সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে যে অত্যন্ত বড় ধরনের ক্ষতি হয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সরকারসহ বিভিন্ন মহল থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে, তার পরও দুর্ঘটনা না কমে বরং দিনে দিনে বাড়ছে। এর নানা কারণ রয়েছে। রাস্তায় যদি একধরনের গাড়ি চলে, তাহলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম থাকবে। কিন্তু রাস্তায় যদি একাধিক ধরনের গাড়ি চলে, তাহলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। সড়ক প্রশস্ত না করে আমরা যদি গাড়ির সংখ্যা অথবা যাত্রী পরিবহনের পরিমাণ বাড়াই, তাহলে দুর্ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেড়ে যেতে পারে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গাড়ির পরিমাণ বাড়ছে। যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় সড়কের পরিমাণ বা আয়তন বাড়ছে না। আমরা ইচ্ছে করলেও অনেক সময় নানা সীমাবদ্ধতার কারণে রাস্তার প্রশস্ততা বাড়াতে পারব না। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে যতসংখ্যক গাড়ি চলাচল করে, এবং যাত্রী পরিবহন করা হয়, তা অত্যন্ত বেশি। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এত স্বল্পায়তন রাস্তায় এত বেশিসংখ্যক গাড়ি চলাচল করে। ফলে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এজন্য ম্যাচিং ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ম্যাচিং ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থাকলেও আমাদের দেশে এখনো এ ধরনের কোনো ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা হয়তো কোনো একটি রাস্তার পাশে ফুটপাত তৈরি করেই দায়িত্ব শেষ করছি। কিন্তু সেই ফুটপাত দিয়ে জনগণের চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে কি না, তা আমরা দেখার প্রয়োজন বোধ করছি না। যিনি ফুটপাত ব্যবহার করবেন, তিনি তা দিয়ে নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে পারছেন কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি যদি ফ্লাইওভারে উঠতে চান, তাহলে সেই ফুটপাত তাকে নিরাপদে সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। সড়ক নিরাপত্তার জন্য যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়, প্রায়শই দেখা যায় সেগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দোকান মালিক ফুটপাতের ওপর রড দিয়ে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখেন। এতে পথচারী চাইলেই স্বচ্ছন্দে ফুটপাত ব্যবহার করতে পারেন না।

বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব থেকে জানা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ মিলিয়ন, অর্থাত্ ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ১৫ জন। ভারতে ২২ জন এবং পাকিস্তানে ১৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া দুর্ঘটনায় মৃত্যুহারের তুলনায় বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে মৃত্যুহার অনেক বেশি দেখানো হয়। সরকার যেখানে বলছে, প্রতি বছর ৫ হাজারের কিছু বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেখানে বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, মৃত্যুর এই সংখ্যা ২৫ হাজারের মতো। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা কম-বেশি ১০ গুণ। আহতদের মধ্যে অনেকেই চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। বিশ্বে প্রতি বছর ১ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন (প্রায় ১৩ লাখ ৫০ হাজার) মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ স্থানীয়ভাবে আহত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি। বর্তমানে দেশে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে প্রতি বছর অসংক্রামক ব্যাধির কারণে যতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। সড়ক দুর্ঘটনা একটি ক্রাইম। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে পুলিশ তা রেকর্ড করলেও আহতদের পরিসংখ্যান পুলিশ সাধারণত সংরক্ষণ করে না।

সড়ক দুর্ঘটনার আরো কিছু কারণ রয়েছে। অনেক সময় গাড়িচালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে কে কাকে পেছনে ফেলে যেতে পারবেন। কোনো কোনো মহাসড়কে বাঁক বেশি থাকে। যে কারণে সেই সব বাঁক পেরোতে গিয়ে গাড়িচালকগণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। যারা গাড়ি চালান, তাদের অনেকেরই উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থাকে না। যে কারণে তারা ট্রাফিক আইন সম্পর্কেও ভালোভাবে জ্ঞাত নন। সড়কে প্রায়ই ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে। এসব গাড়ি যে কোনো সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। গাড়িচালকদের মধ্যে অধিকাংশই ট্রাফিক আইন মানতে চান না। চালকদের আইন মেনে চলার জন্য বাধ্য করার কোনো ব্যবস্থা নেই। গাড়িচালকদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা নিয়মিত নেশাজাতীয় বস্তু গ্রহণ করেন। ফলে তারা স্বাভাবিক অবস্থায় গাড়ি চালাতে পারেন না। কেউ আবার ঘুমের চোখে গাড়ি চালান। গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রেও নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়। বাংলাদেশে যেসব সেক্টর সবচেয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তার মধ্যে সড়ক পরিবহন খাত উল্লেখযোগ্য। যারা পরিবহনের মালিক তারা রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকতে ভালোবাসেন। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি, সরকার আইন প্রণয়ন করলেও পরিবহনের মালিকদের চাপের কারণে তা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কি শুধু গাড়িচালকেরাই দায়ী? যারা রাস্তাঘাটে চলাচল করে, তাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? যারা পথচারী তাদের মধ্যে অনেকই অত্যন্ত অসচেতনভাবে রাস্তায় চলাচল করে। ফলে বিভিন্ন সময়ে এরা মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ে হয়ে জীবন হারায়। কিছু কিছু পথচারীর মধ্যে এমন প্রবণতা রয়েছে যে, তারা ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি রাস্তা পেরোতে চায়। রাস্তা পার হতে গিয়ে অনেক সময় তারা দুর্ঘটনায় পড়ে। শুধু আইন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার মতো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। জীবনের চেয়ে সময়ের মূল্য কোনোভাবেই বেশি হতে পারে না। তাই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। ট্রফিক আইনকে আরো যুগোপযোগী করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাই যেন আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। মাঝেমধ্যে একটি স্লোগান চোখে পড়ে—‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।’ আমরা চাই না দুর্ঘটনার কারণে আর একটি জীবনও অকালে ঝরে যাক। কারণ জীবন অনেক মূল্যবান, শত চেষ্টা করলেও জীবন চলে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

লেখক: অধ্যাপক, অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই), বুয়েট, ঢাকা

অনুলিখন: এম এ খালেক

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন