শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি ও বাঙালির মনস্তত্ত্ব

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৩০

মনোবিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের একজন হচ্ছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ব্যক্তিত্ব মতবাদে তার মনঃসমীক্ষণ অ্যাপ্রোচ সর্বাধিক পরিচিত। যেখানে তিনি ব্যক্তিত্বের গঠন কাঠামোয় মানব মনের তিনটি স্তরের কথা বলেছেন। সবচেয়ে নিচে রয়েছে অচেতন স্তর—যা সর্বাধিক বিস্তৃত, পাপপূর্ণ ও জঘন্য প্রকৃতির। ব্যক্তির জন্মগত আদিম কামনা-বাসনা ও প্রবৃত্তিসমূহ এই স্তরে বিরাজ করে। আর সবার ওপরে চেতন স্তর—যেখানে আবেগ,অনুভূতি, চিন্তাভাবনার বসতি। মানুষ বেশির ভাগ সময় চেতন স্তরে থাকে। এ স্তরের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ ও পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। স্তরটির ব্যপ্তি খুব ছোট। এর ব্যাপ্তি যার যত বেশি, সে তত সচেতন থাকে। তার আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণে থাকে। লোভ-লালসা পরিহার করতে সমর্থ হয়। তাই সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে। ভাবতে বাধ্য হই—ফ্রয়েডের বেড়ে ওঠা ও গবেষণা নিশ্চয়ই আমাদের এ ভূখণ্ডে ছিল না। তাই এই মতবাদ বাঙালির জন্য কতটুকু প্রযোজ্য, তা বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন। এই সূত্র ধরেই আমরা বলতে পারি, বিশ্ব জুড়ে সমগ্র মানবজাতির দৈনন্দিন কাজকর্মে মানবমনের চেতন স্তর কাজ করলেও বাঙালি হরহামেশা যা করে, তা অচেতন স্তর থেকেই। যেখানে তার প্রবৃত্তিসমূহ বিদ্যমান। লোভ বলি আর লালসা, স্বার্থপরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতার নৈপুণ্যে উথলে পড়া এক জাতি। সুযোগের সদ্ব্যবহারে সর্বদা সচেষ্ট। কোনো কাণ্ডই সাধারণ কাণ্ড নয়, তা একেবারে তুলকালামে পরিণত করাই এ জাতির কর্ম। আমদানিকৃত কিছু পণ্য—তেল, গম, চিনি, পেঁয়াজের কথা না হয় বাদই দিলাম। শতভাগ দেশে উত্পাদিত কাঁচা মরিচ সপ্তাহান্তে বেড়ে হয়েছে ১০ গুণ। ডেঙ্গুর মৌসুমে ডাব মনে হয় যেন রাশিয়া-ইউক্রেনের পণ্য। আলু কিনতেও হিমশিম খাচ্ছে জনগণ। চাহিদার তুলনায় ২০ লাখ টন বেশি উত্পাদিত হলেও হিমাগার ও মজুতদারের দৌরাত্ম্যে ১০ টাকার আলু ৫০ টাকা! দেশে প্রতি বছরই ডিম, দুধ ও মাংসের উত্পাদন বাড়ছে। তা সত্ত্বেও বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। উত্পাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বাড়ছে। চাহিদার সঙ্গে উত্পাদন বাড়লে দাম বাড়ার কথা নয়। তাই কেউ কেউ সরকারিভাবে উত্পাদনের এই তথ্যের দিকে সন্দেহের তির ছুড়ছে। খাতা-কলমভিত্তিক উত্পাদন বাড়লেও মূল্যস্ফীতির বাস্তবতা বড়ই কঠিন, অসহনীয়।

সাধারণের দুর্ভাবনার ব্যামোই এখন নিত্যসঙ্গী। বাজার পরিস্থিতি ঘরে-বাইরে সব জায়গায় অশান্তি তৈরি করছে। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই, যা নিয়ে অসাধুরা সিন্ডিকেট করছে না। কষ্ট করে বাজার করলেও গিন্নির রান্নায় আগের মতো স্বাদ নেই। কারণ মসলার বাজারে আগুন। তেল, পেঁয়াজ, রসুন কম দিয়ে এক দুঃসাধ্য সাধনের ব্যর্থ চেষ্টা। অবশেষে সংসারে লক্ষ্মী নেই। যে যার ইচ্ছেমতো মূল্য বাড়িয়ে অতিমুনাফা করছে। অর্থনীতির পূর্বানুমান হচ্ছে—সব মানুষই স্বার্থপর। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদীব্যবস্থার মূলেই রয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ। তাই বলে বছরব্যাপী একটির পর একটি পণ্য নিয়ে কারসাজি—এটি তো শুধু বাড়াবড়িই নয়, একপ্রকার জুলুম। যে বা যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করবে, তারা নির্বিকার। অ্যাডাম স্মিথ বাজারের অদৃশ্য হাতের কথা বলেছেন, কিন্তু এর মাজেজা আমাদের বাজারব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আমাদের করপোরেট হাতগুলো তো দৃশ্যমান। তবে তা এত শক্তিশালী যে, খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী এই সিন্ডিকেট ভাঙায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরবেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানান। এর মধ্যে আবার সাধারণ জনগণ ও অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অর্থনীতি বোঝা-না-বোঝা নিয়ে চলছে বোঝাপড়া। সম্প্রতি দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ জরিপ বলছে—দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, অর্থনীতি ভুল পথে এগোচ্ছে। এতেই অর্থমন্ত্রী কিছুটা চটেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন—যারা অর্থনীতি ভালো নেই বলেন, তারা অর্থনীতি বোঝেন না। আমজনতা অর্থনীতি বুঝবে না এটাই স্বাভাবিক, এখানে মতপার্থক্যের শেষ নেই। ক্ষণে ক্ষণে মতের পরিবর্তন হয়। আর অর্থনীতি তো হচ্ছে একটি বিজ্ঞান। কার্লাইলের ভাষায় অর্থনীতি তার জন্মলগ্ন থেকেই হতাশাবাদী বিজ্ঞান। অর্থনীতি হচ্ছে সোজা বিষয়ে বেদনাদায়ক সম্প্রসারণ। আর তা বোঝার মতো স্মার্ট বিজ্ঞানমনস্ক জনগণ তৈরির ব্যর্থতাও তো সরকারের ঘাড়ে। আমাদের অতিসাধারণ জনগণেরও এ মূর্খতা নিয়ে দুঃখ নেই। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানও খুব বেশি অর্থনীতি বুঝতেন না। অর্থনীতির বিতর্কে তিনি বলতেন, ‘আমি দুই হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ চাই না। চাই এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ।’ অর্থনীতির মতপার্থক্যে তিনি বিরক্ত ছিলেন। জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সব অর্থনীতিবিদকে বিছিয়ে দিলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। বছর ধরে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি দেশে অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে।

সময়টা বেশ আগের ১৯৭৫-১৯৯১ সালে ইউরোপে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়—মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশ বাড়লে সুখের গড় পরিমাপ (১ থেকে ৪ স্কেলে) ৩ দশমিক ২ থেকে ৩ দশমিক ১ শতাংশে কমে আসে। আপাতদৃষ্টিতে এ প্রভাব ক্ষীণ মনে হলেও মূল্যস্ফীতির হার লক্ষণীয়ভাবে বাড়লে সুখের ওপর তার সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যদি মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ বাড়ে, তাহলে এক্ষেত্রে সুখের গড় পরিমাপ ৩ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে। আমাদের দেশে যে হারে মূল্যস্ফীতি চলছে, তাতে জনগণের সুখের যে কী ভয়াবহ অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাজারের অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। বিশ্বের সব দেশেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এ খোঁজ সবাই রাখে। তাই তো সাধারণের হতাশার মাত্রা চরমে। অথচ সরকার এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলেছিল।

অর্থনীতিবিদদের মতে, চলমান এ সংকট শিগিগর কাটবে না। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকেরও একই সুর—আগামী দুই বছর এ অস্থিরতা থাকবে। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো, সমস্যা বুঝতে না পারা অথবা বুঝেও স্বীকার না করে দিবানিদ্রায় থাকা, যা সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করে দূর থেকে শনির দৃষ্টি শানিত করছে। তাই সমস্যা বুঝতে পারার মধ্যেই সমাধানের বীজ নিহিত। দুর্বলতা বুঝতে পারাই সংকট কাটিয়ে শক্তি সঞ্চয়ের প্রথম শর্ত। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে— নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বড় করে না দেখে ভোক্তাদের স্বার্থে গুরুত্ব দিতে হবে। বাজার প্রতিযোগিতার পরিবর্তে কতিপয় করপোরেট ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য রোধ করে ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট বা স্বজনতোষী পুঁজিপতিদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে হবে। প্রাচীন গ্রিসের ডেলফি নগরের ভবিষ্যদ্বাণীর মন্দিরের প্রধান ফটকে লিপিবদ্ধ ছিল—‘কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি করবে না।’ বাড়াবাড়ি হয় রিপু থেকে, যা কোনো কিছু সৃষ্টি করে না, বরং ধ্বংস করে। ষড়িরপুর অন্যতম হলো—‘লোভ’। এ ব্যাপারে ফ্রাংক বুখম্যান যথার্থই বলেছেন, ‘পৃথিবীর সকলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে কিন্তু সকলের লোভ মেটানোর মতো যথেষ্ট সম্পদ নেই।’ সেখানে আমাদের ব্যবসায়ীদের লোভের স্ফীতি ঘটেছে। এটি প্রথমত করপোরেট থেকে শুরু হয়ে ডাবওয়ালা পর্যন্ত ঠেকেছে। বড়দের কাছ থেকে ছোটদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। এটি বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের ব্যবসায়ীরা কোন সত্তা দ্বারা প্রভাবিত? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন—সেটি হলো ‘আদিম সত্তা’। তারা শুধু অন্ধের মতো জৈবিক প্রেষণাগুলো চরিতার্থ করার উপায় খোঁজে। পরিণতি যা-ই হোক বা না হোক, সর্বদা নিজেদের কামনার পরিতৃপ্তি ঘটাতে চায়।

দৈনন্দিন জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নকে এড়ানো অসম্ভব। প্রতিদিন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ৪৪ থেকে ৪৫টি দল অভিযান পরিচালনা করে জেল জরিমানা ও মামলার জট বাঁধিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে বা ব্যক্তিত্বে যে জট ঢুকে বসে আছে, সেখানে পরিবর্তন করতে না পারলে কোনো কিছুতেই এখান থেকে মুক্তি মিলবে না।

লেখক :পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন