কথায় বলে, ‘কোনো কিছুই অর্ধসমাপ্ত ভালো নয়। বরং এতে বিপরীতধর্মী ফল লাভের আশঙ্কা থাকে।’ দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কথাটি অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে প্রযোজ্য। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল কি সাধারণ মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারছে? উন্নয়নের সুফল সামান্য কিছু ভাগ্যবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এটাকে কোনোভাবেই সঠিক উন্নয়ন কৌশল বলা যায় না। টেকসই উন্নয়ন কৌশল তো নয়ই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে দেশের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন কোনো কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, দেশের মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রদর্শিত হারের চেয়ে অনেকটাই বেশি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হচ্ছে না, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় বা রিয়েল ইনকাম কোনোভাবেই বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানুষের পারচেজিং পাওয়ারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
এক হালি ডিমের দাম যদি ৫০০ টাকাও হয়, তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই, যদি এক হালি ডিম কেনার জন্য আমার হাতে ৫০০ টাকা থাকে। তেমনি মূল্যস্ফীতি যদি শতভাগ হয়, তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই, যদি একই সময়ে আমার রোজগার ২০০ ভাগ বাড়ে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরির হার বা আয় না বাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি মানুষের আয় বা মজুরি বাড়লেও এর হার খুবই কম। ফলে সাধারণ নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ বাড়ার পাশাপাশি মানুষের আয় বা মজুরি যদি ১২ শতাংশ বা তারও বেশি বাড়ত, তাহলে কোনো অসুবিধা হতো না। বর্ধিত আয় দ্বারা তিনি উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত মোকাবিলা করতে পারতেন। একদিকে উন্নয়নের গুণগান করা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই সাধারণ দরিদ্র মানুষ অসহায় অবস্থায় দুমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার করছে। অনেকেই গর্ব করে বলেন, এখন আর মানুষ না খেয়ে থাকছে না। যারা এমন কথা বলেন, তারা কি সাধারণ দরিদ্র মানুষের ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) পণ্যবাহী ট্রাকের পেছনে দরিদ্র মানুষের সারি দেখলেই অনুধাবন করা যায়, তারা কতটা অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছে।
বিশ্বব্যাপী অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে—এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অনেক আগে থেকেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও আমরা তাকে খুব একটা আমল দিইনি। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অর্থনীতিবিদদের অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, আমাদের দেশেও উচ্চতর মূল্যস্ফীতি শুরু হতে পারে। তাই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ভাগ্য ভালো যে, বাংলাদেশের সৃজনশীল পরিশ্রমি কৃষক খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছেন, তা না হলে আমাদের অবস্থা কেমন হতো ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে অনেকটাই সফল হয়েছে। কিন্তু আমরা কেন এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হতে পারছি না—এই প্রশ্ন সংগত কারণেই এসে যায়। আকস্মিক মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব ব্যবস্থার ফলে সাময়িকভাবে হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর মধ্যে প্রধান যে ব্যবস্থাটি গ্রহণ করা হয় তা হচ্ছে, বাজারে মুদ্রার জোগান বা সরবরাহ কমিয়ে আনার জন্য পলিসি রেট বাড়ানো। শিডিউল ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য যে ঋণ বা ধার গ্রহণ করে, তার ওপর যে সুদ চার্জ করা হয়, সেটাই পলিসি রেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এক বছরের মধ্যে অন্তত ১২ বার তাদের পলিসি রেট বাড়িয়েছে। পলিসি রেট বাড়ালে সিডিউল ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় অধিকতর ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় শিডিউল ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা ও সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে উচ্চ সুদ চার্জ করে। এতে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ আগের চেয়ে ‘কস্টলি’ বা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় ব্যাংকগুলো চাইলেই আগের মতো ব্যাপক মাত্রায় ঋণ দিতে পারে না। ফলে বাজারে অর্থের প্রবাহ কমে যায়। মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি একপর্যায়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়, যা ছিল গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) ঢালাওভাবে নীতি সুদহার বাড়াতে থাকে। নীতি সুদহার বাড়ানো হলে সংশ্লিষ্ট দেশে আর্থিক মন্দা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ ঋণের প্রবাহ কমে গেলে বিনিয়োগকারীগণ নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারেন না। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই ঝুঁকি নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। ফলে তাদের মূল্যস্ফীতি অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণে পলিসি রেট বাড়িয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশও তো পলিসি রেট একাধিক বার বাড়িয়েছে। তার পরও কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না? বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, কাউকে পায়ে দড়ি বেঁধে দৌড়াতে দিলে যে অবস্থা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বাড়ানোর উদ্যোগটি ছিল ঠিক তেমনি। বাংলাদেশ ব্যাংক তিন বারে পলিসি রেট ১ শতাংশ বাড়িয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার আনুপাতিক হারে বাড়ার কথা থাকলেও কার্যত তা হয়নি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের ‘আপার ক্যাপ’ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা এই উদ্যোগকে ‘নয়ছয়’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ানোর ফলে শিডিউল ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সময় আগের তুলনায় ১ শতাংশ বেশি সুদ দিতে হয়। কিন্তু বর্ধিত পলিসি রেটে বাংলাদেশ থেকে ঋণ এনে সেই অর্থ শিডিউল ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশ সুদে উদ্যোক্তা ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে প্রদান করতে হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণদানকালে গৃহীত সুদের হার বা মুনাফা কমে যায়। তারা ঋণদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ব্যাংকগুলো ঋণ মঞ্জুর করতে না চাইলেও একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে নানা উপায়ে চাপ সৃষ্টি করে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ বের করে নিয়ে যায়। অনেকের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা, বর্তমানে চলমান মুদ্রানীতির আগের মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ গত বছরের আগস্ট মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের ভালো প্রবৃদ্ধি হওয়ার অর্থই হলো দেশে প্রচুরসংখ্যক কলকারখানা স্থাপিত হওয়া তথা শিল্পায়নে গতিশীলতা ফিরে আসা। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের এই লক্ষ্যাতিরিক্ত অর্জনকে আমরা অবশ্যই ভালো বলতাম, যদি তা বিনিয়োগ হতো। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো গতিশীলতা সৃষ্টি হয়নি। সেই সময় শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ করে। আর ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছিল ৭৬ শতাংশ। তাহলে ব্যাংক থেকে যে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছিল, তা কোথায় গেল? এই অর্থ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করেছে। ফলে বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। কারো কারো মতে, এই ঋণকৃত অর্থের একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি কিন্তু বহাল থাকেনি। মে মাসে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ, জুন মাসে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জুলাই মাসে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অবস্থা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ার আমদানিকারকগণ চাইলেই এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে পারছেন না। ফলে আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে গেছে।
এছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাজারে বিদ্যমান রাজনৈতিক সিন্ডিকেট দমনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে এই সিন্ডিকেট যখন-তখন যে কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। বাজারে তত্পর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে কোনোভাবেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
লেখক: বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক জি এম, অর্থনীতি বিশ্লেষক