শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

শান্তির আশা যেন দুরাশা হইয়া উঠিয়াছে

আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:১৪

এক অস্বস্তিকর টলায়মান বিশ্বপরিস্থিতি সার্বিকভাবে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করিতেছে। বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আরো কত শত বত্সর অপেক্ষা করিতে হইবে—কেহ জানে না। সারা বিশ্বেই ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক সংঘাত, শক্তি প্রর্দশনের চাঁদমারি হইয়া উঠিয়াছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যুদ্ধ, সন্দেহ, বিভাজন ও সংঘাতের পরিবর্তে শান্তি, বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা চাহে। চাহে বটে, কিন্তু ‘চাওয়া ও পাওয়া’র ভিতরে বিস্তর ব্যবধান দৃশ্যমান। বলা হইতেছে, সকলের স্বার্থেই বিশ্বে সমঝোতা প্রয়োজন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বলিয়াছেন যে, প্রকৃত ও বাস্তব সমাধানের জন্য এখন সময় আসিয়াছে একত্রিত হইবার। তাহার মতে, রাজনীতি মানেই সমঝোতা, কূটনীতি মানেও সমঝোতা এবং কার্যকর নেতৃত্বও সমঝোতা।

খুবই চমত্কার কথা। কিন্তু চারিদিকে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় মানবতা পদদলিত হইতেছে, ক্রমশ গুরুতর হইতেছে জলবায়ু পরিস্থিতি, বাড়িতেছে জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকট, তখন দেশে দেশে ক্রমবর্ধমান সংঘাত সম্পূর্ণ বিশ্বকে আরো নাজুক করিয়া তুলিতেছে। গত পাঁচ দশকে একটি বহুমুখী বিশ্ব গড়িয়া উঠিয়াছে। অনেকে মনে করেন, বহুমুখিতা ভারসাম্যের একটি কারণ হইতে পারে। কিন্তু উহাকে যেন থিওরিটিক্যাল কথা বলিয়া মনে হইতেছে। তাহা না হইলে এই বহুমুখী বিশ্বে কেন ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা, বিভাজন, স্বার্থের ভিন্নতা, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভিন্ন সংস্কৃতি কেন ভারসাম্য না আনিয়া বিপর্যয় আনিতেছে? সমস্যাটা আসলে কোথায়? কতদিন চলিবে এই বিপর্যয়কর টলায়মান পরিস্থিতি? প্রতিটি দেশই চাহে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত্। কিন্তু শান্তি, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও সুশাসনের ক্ষেত্রে ঘাটতি বাড়িতেছে দিকে দিকে। সংকটে পড়িতেছে মানবতা। বহু মেরুর বিশ্ব ও অর্থনীতির বিশ্বায়ন বিকশিত হইতেছে বটে, কিন্তু পানিও ঘোলা হইতেছে তাহার সহিত। চীন কোরীয় উপদ্বীপে অস্থিতিশীলতা, ফিলিস্তিনের জনগণের বৈধ নাগরিক অধিকার, ইরানের পরমাণু ইস্যুর পাশাপাশি সিরিয়া, সুদান, লিবিয়া ও ইয়েমেন সংকটেরও রাজনৈতিক সমাধান কোথায়? আফ্রিকার জনগণ আর কতদিন বিশ্ব মোড়লদের চাঁদমারি হইয়া থাকিবে?

এই রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বকে নূতন নূতন অভাবিত সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করাইয়া দিতেছে। লিবিয়ায় অভাবিত ও অতি বিপর্যকর বন্যায় কয়েক দিনের ব্যবধানে ২০ হাজারের কাছাকাছি মানুষ মারা গিয়াছে। অন্যদিকে বিশ্বের রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করিতেছে বিশ্বের অর্থনীতিকে। টমাস ফ্রিডম্যান তাহার ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন, বিশ্বায়নের কারণে বিশ্ব সকলের নিকট সমান ও অনুরূপভাবে উন্মুক্ত হইয়া উঠিতেছিল। সহযোগিতা এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করিবার ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সংস্থাগুলির নূতন করিয়া পাওয়া ক্ষমতা বিশ্বকে আরো সমতাপূর্ণ ও সমশ্রেণিভুক্ত করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইহার বিপরীতে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাও বৃদ্ধি করিয়াছে। বিশ্বায়নের অন্যতম অঙ্গ—বাণিজ্য উদারীকরণ, বাণিজ্যিক ঘাটতিকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে বাড়াইয়া দিয়াছে।

দেখা যাইতেছে, ভূরাজনৈতিক এই বিভাজন যেন আমাদের ক্রমশ ‘ভূত’ বানাইয়া দিতেছে। ভূতের যেমন পিছন দিকে পা থাকে, সামনে অগ্রসর হইলেও ভূত আসলে পিছনের দিকেই চলিয়া যায়; আমরা তেমনি যত সামনের দিকে আগাইতে চেষ্টা করিতেছি ততই যেন পিছাইয়া পড়িতেছি। এই যখন অবস্থা, তখন বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের কি ভালো থাকিবার সুযোগ রহিয়াছে? কিংবা কোনো দেশ চাহিলেই কি নিজের মতো করিয়া ভালো থাকিতে পারিবে? রবীন্দ্রনাথ যেমন বলিয়াছেন—‘বহুদিন মনে ছিল আশা/ ধরণীর এক কোণে/ রহিব আপন-মনে;/ ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা/ করেছিনু আশা।’ সেই আশায় এখন গুঁড়েবালি। আসলে বিনিসুতার মালার মতো বিশ্বের সকলে মিলিয়া একটি একক মালা। এই মালায় কোথায় সুতা ছিঁড়িয়া গেলে, কোথাও কোনো ফুলে পচন ধরিলে তাহার অভিঘাত অন্য ফুলের উপরও পড়িতে বাধ্য। সুতরাং সম্মিলিত সুষ্ঠু বুদ্ধি, স্যাক্রিফাইস ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই কেবল বিশ্বশান্তি আসিতে পারে। কিন্তু তাহাতে যে অনেকের ‘লোকসান’ হইবে। কিন্তু যাহাদের লোকসান হইবে, তাহারা যদি ‘লাভ’ ব্যতীত আর কিছু না বুঝেন—তাহা হইলে উপায় কী? উপায় আমাদের জানা নাই।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন