রোগ হলে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ রোগেরই প্রতিকার হিসেবে আমরা কোনো না কোনো ওষুধ গ্রহণ করি। ওষুধ গ্রহণ করার প্রক্রিয়ায় এসেছে নানান পরিবর্তন। প্রাচীনকাল থেকেই চিকিত্সক রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে ওষুধ প্রদান করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আসছে। কিন্তু দিন দিন এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে চলেছে। জনসংখ্যার আধিক্য, বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রনিক ডিজিজের প্রকোপ, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, জীবনধারার পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে মানুষের ওষুধ গ্রহণ দিন দিন বাড়ছেই। এছাড়া অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ফলে টাকমাথা, স্কিনের সতেজতা রক্ষাকারী, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ গ্রহণও বেড়েছে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি পেশায় পরিবর্তন এসেছে। ফলে বিংশ শতাব্দীতে চিকিত্সক মূলত রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন। ওষুধ তৈরির দায়িত্ব চলে এসেছে ফার্মাসিস্টদের কাছে। কিন্তু ঐ সময়ের পর বাজারে ওষুধের সংখ্যা বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি রোগের আলাদা আলাদা ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে ফার্মাসিস্টরা শুধু ওষুধ তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না। স্বাস্থ্যসেবায় গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের আরো বেশি সম্পৃক্ত করার প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে। ফলে এখন হেলথ কেয়ারের পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যাল কেয়ার ব্যবহূত হচ্ছে। অর্থাত্ ওষুধ শুধু তৈরি করে দিলেই হবে না, ওষুধের নিরাপদ, যৌক্তিক ও সঠিক উপায়ে গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
একটি পেশার উত্পত্তি হয় সমাজকে সেবা দেওয়ার জন্য। ফার্মেসি পেশার উদ্ভব হয়েছিল সে কারণে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ওষুধসেবার নিত্য নতুন পদ্ধতিকেও ফার্মেসি পেশাতে ধারণ করতে হচ্ছে। ফার্মেসি পেশায় তিন ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবল রয়েছে। প্রথমত, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বা পাঁচ বছর মেয়াদি ফার্মাসি সম্মান বিষয়ে পাশ করা গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট। তাঁরা মূলত ওষুধের উত্পাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধের নিরাপদ ব্যবহারের ওপর দীর্ঘ পড়াশোনা শেষে একজন দক্ষ গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হিসেবে সমাজে অবদান রাখতে পারেন। তারা মূলত শিক্ষক বা গবেষণা বা ওষুধ তৈরি, ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করেন। তাদের কাজের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। দ্বিতীয়ত, এসএসসি পাস করে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ফার্মাসি পড়াশোনা শেষে মূলত হাসপাতালগুলোতে ওষুধ বিতরণে কাজ করছেন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টরা। তৃতীয়ত, এসএসসি পাশ করে তিন মাসের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ শেষে ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ বিতরণের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ফার্মেসি শিক্ষানবিশেরা। রোগীর দেহে যে কোনো ওষুধ প্রয়োগের একমাত্র অধিকার রাখেন ফার্মাসিস্ট।
রোগী ও চিকিত্সকের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর সর্বোত্তম মাধ্যম হলেন একজন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট। বিশেষ করে চিকিত্সক প্রদত্ত প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণে রোগীকে সহায়তার মূল কাজটি একজন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট করে থাকেন। ফলে রোগী প্রেসক্রিপশন পাওয়ার পর থেকে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের কাছে ওষুধবিষয়ক সমস্যার যথাযথ নির্দেশনা পেতে পারেন। সুতরাং একজন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টকে সাধারণ মানুষ ও চিকিত্সকের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার মতো সক্ষম হতে হবে। গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টকে গবেষক, উত্পাদক, ওষুধের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে উন্নত বিশ্বে ফার্মাসি কারিকুলামেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
১৯৯৯ সালে ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসি ফ্যাকাল্টি গবেষণাভিত্তিক ফার্মাসিশিক্ষা থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল কেয়ারভিত্তিক কোর্স কারিকুলামের প্রস্তাব করেছিল। ফলে ফার্মাসিশিক্ষার প্রসার চার বছর মেয়াদি থেকে ছয় বছর মেয়াদি ফার্ম ডি ডিগ্রিতে রূপান্তর করা হয়। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব কলেজ অব ফার্মাসি, অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল অব ফার্মাসি এডুকেশন এবং আমেরিকান ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলে ডক্টর অব ফার্মাসি কোর্স (ফার্ম ডি) অনুমোদন দেয়; যা ২০০০ সালে শুরু হয়। শুধু তাই নয়, অ্যাডভান্স ফার্মাসি প্র্যাকটিস এক্সপেরিয়েন্স নামক ৩৬ সপ্তাহের একটি ট্রেনিং শেষ করে তবেই রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট হতে পারেন। ইতিমধ্যে দেশের ৪০টির অধিক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় প্রতিবছর এক হাজারের বেশি মানসম্পন্ন গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট পাশ করে দেশের ওষুধশিল্পে কাজ করছেন। হাসপাতালে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট কাজ করছেন, কিন্তু সংখ্যায় খুবই কম, আরো ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট দরকার। তাই অবিলম্বে হাসপাতালগুলোতে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ফার্মেসি ব্যবস্থাপনা চালু করা জরুরি।