অভাব মানুষকে বরাবরই সাহসী, অকল্পনীয় ও নতুন কোনো কাজ করতে উদ্যত করে। সে অভাব হতে পারে অর্থের, হতে পারে ভালোবাসার, হতে পারে এমন কারোর উপস্থিতির অভাব যার জন্য হয়তো সকল পাওয়াও পূর্ণতা পায় না। তেমনই আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা ও মানুষের সকল কর্ম ও সিদ্ধান্তকে ক্রমাগত ধাবিত করে।
মানুষের হৃদয় কিন্তু সে সবের ধার ধারে না! তার বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট্ট একটা হৃদয়- বাস্তবতা, বাহ্যিক পরিস্থিতি সে বোঝে না। কখন যে সে নিজেকে অন্য কোনো হৃদয়ের কাছে বিলিয়ে দেবে, হৃদয় নিজেও তা জানে না।
বাস্তবতার তাড়নায় ও হৃদয়ের বেখেয়ালে জন্ম নেওয়া এক প্রণয়ের গল্প ‘সঞ্চারিণী’। বইটির লেখক, মিশু মনি’র ভাষায়, গল্পের প্রধান চরিত্র দীপ্র ও মার্ফি যেন তারই দুই সত্তা। প্রচণ্ড রকম বেখেয়ালি এবং পাগলাটে কিন্তু এরাও বাস্তবতার জীর্ণতার মাঝেই ভালোবাসায় জড়ায়।
‘সঞ্চারিণী’র দুই প্রধান চরিত্র দীপ্র ও মার্ফি। দীপ্র, এক পাগলাটে লেখক। লোকালয়, কোলাহল থেকে দূরে, নিরিবিলি বিশাল বড় এক সাদা বাড়িতে সে একা থাকে। সাদা বাড়িটি যেন তার মনের শুভ্রতারই প্রতীক। দীপ্রর প্রেম বিহঙ্গদের গানে, বৃক্ষের ছায়ায়, প্রকৃতির শীতল বাতাসের সঙ্গে। সে তার আপন খেয়ালে বহমান- বদ্ধ ঘরে বসে গল্প লেখে; উদ্ভট, বেখেয়ালি তার জীবন। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন দীপ্রর সাদা বাড়িতে একদিন আগমন ঘটে এক তরুণীর- ‘মার্ফি’। দীপ্রর জীবনে মার্ফি যেন কোনো অনাবশ্যক ঝড়ের আগে হঠাৎ আসা দমকা হাওয়া।
এই তরুণী এসে দীপ্রকে জানায়, সে তার বিবাহিতা স্ত্রী এবং থাকা শুরু করে মার্ফি দীপ্র’র সাদা বাড়িতে। কিন্তু কেন হঠাৎ করে আসে মার্ফি দীপ্র’র কাছে? কেন বলে সে তার বিবাহিতা স্ত্রী? অভাবের তাড়না থেকে মুক্ত করতে মার্ফি নিজেকে জড়িয়ে নেয় এক অকল্পনীয় খেলায়। এ খেলায় তাকে জিততেই হবে। দীপ্রকে তার প্রতি ভালোবাসার মায়ায় জড়াতেই হবে, আবার সেই মায়ার বাঁধন মুক্ত করে দিয়ে একদিন হারিয়েও যেতে হবে।
মার্ফি সফলও হয়, কিন্তু হেরে যায় তার হৃদয়। কারণ হৃদয় তো আর বাস্তবতার ধার ধারে না। কল্পনার জগতে তার বিচরণ নিজের মতো। কোনো কাল্পনিক গল্পের মতোই হঠাৎ আসা ভালোবাসার মায়ায় পড়ে যায় দীপ্র’র মনও। তবে কি বাস্তবতার বাঁধা ভেঙে এক হয় দুই হৃদয়ের? সে প্রশ্নের উত্তর মেলে গল্পের একদম শেষে।
সম্পূর্ণ গল্পের গতি ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম। সমান আগ্রহই ধরে রেখে, ‘তার পরে কী হলো?’ প্রশ্নটি উদয় হবে গল্পের শেষ অধ্যায়ে এসে। গল্পে রোজারিও এবং আরও দুই-একজন বন্ধুর উল্লেখ না থাকলে অপ্রাসঙ্গিকতা এড়ানো যেত। তবে সুলতান চাচা সহকারী চরিত্র হয়েও গল্পের সঙ্গে বেশ সাবলীলভাবেই মানিয়ে যায়।
এ রকম সহজ অথচ আগ্রহ জাগানিয়া একটি গল্পে যে বিষয়টির অনুপস্থিতি বেশ চোখে লাগে তা হলো, চরিত্রগুলোর বাহ্যিক অবয়বের ব্যাখ্যা। দীপ্র দেখতে কেমন? সে কি চশমা পড়ে? মাথা ভর্তি কি ঝাকড়া চুল? মার্ফি কেমন? ও কি কপালে টিপ আঁকে? চরিত্রগুলোর কাজের দ্বারা তাদের স্বভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও, লেখকের চোখে চরিত্রগুলোর অবয়ব কেমন সেটা জানা যায় না বাহ্যিক অবয়বের ব্যাখ্যার অভাবে।
গল্পের চরিত্র বা বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে পাঠকের খুব বেশি ভাবনার বা প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই, তবে সহজ সাবলীল ভাষায় লেখা বইটি বেশ গোছানো ও সহজ গতিতেই প্রতিটি অধ্যায় এগিয়ে যায়, যা সুখপাঠ্য। লেখক মিশু মনি’র এই বইটি তার অন্যান্য বইগুলো সম্পর্কে পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে।
দাঁড়িকমা থেকে প্রকাশিত ১৬০ পৃষ্ঠার ‘সঞ্চারিণী’ উপন্যাসটি কোনো এক অলস দুপুরে আরাম করে পরে ফেলা যাবে খুব সহজেই। প্রচ্ছদ করেছেন আব্দুল্লাহ মারুফ রুসাফী। মূল্য মাত্র ২৭৫ টাকা।