রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

স্যালাইনেও সিন্ডিকেটের থাবা

  • দেশ জুড়ে মজুতদারের বিরুদ্ধে অভিযান
  • ডেঙ্গু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, রোগীদের ঢাকামুখী হওয়া নিরুত্সাহিত করার নির্দেশ
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:০০

দেশে আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু বৃদ্ধি পাওয়ায় ডেক্সড্রোজ নরমাল স্যালাইনের (ডিএনএস) ও আইভি স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে। আর এই সুযোগকে পুঁজি করে বেসরকারিভাবে স্যালাইন উৎপাদনকারী এবং স্বাস্থ্য খাতের অসাধু চক্র দাম বাড়ানোর জন্য সিন্ডিকেট করে এবার জীবন রক্ষাকারী স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি অধিকাংশ হাসপাতালে স্যালাইন সংকট চলছে। ওষুধের দোকানেও স্যালাইন নেই, অথচ তা পাওয়া যাচ্ছে মুদির দোকানে বেশি দামে—এই ধরনেরও তথ্য পাওয়া গেছে। ডিম, মরিচ, আলু, আদা, রসুন, পেঁয়াজ ও ডাবসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম যেমন সিন্ডিকেট করে বাড়িয়েছে, তেমনি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে স্যালাইনের দামও বাড়ানো হয়েছে। স্যালাইনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং এর দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা স্বাস্থ্য খাতের দুষ্টচক্র হিসেবে পরিচিত। তারা টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। অথচ তারা লম্বা লম্বা কথা বলেন, দলবাজি করেন। করোনা মহামারির পর এখন চলছে ডেঙ্গু মহামারি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা পৃথিবীতে নানা রোগব্যাধি একের পর এক আসতে থাকবে—এটিকে মাথায় নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ স্বাস্থ্য খাতকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।  

কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা চরম গাফিলতি করছেন। এর মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের দুষ্টচক্র। তারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত। মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও হাসপাতালগুলোতে দুর্নীতিবাজদের সাধারণ কর্মচারীরাও চেনে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুদক এই হাসপাতালগুলোর দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে পারছে না কেন, এটাই সিনিয়র ডাক্তারদের প্রশ্ন। যেসব ওষুধ কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন করে, তারা স্বাস্থ্য খাতের দুষ্টচক্রের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে সরকারিভাবে স্যালাইন উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান মহাখালীর পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্যালাইন উৎপাদন। ঐ সময় বিশ্বের উন্নতমানের কাঁচামাল এনে স্যালাইন তৈরি করা হতো। এক যুগ আগে কতিপয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান (যারা স্যালাইন উৎপাদন করে) প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করার জন্য স্বাস্থ্য খাতের দুষ্টচক্রের সঙ্গে হাত মেলায়। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ২৪ জুন বন্ধ করা হয়। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত স্যালাইন খুবই কম মূল্যে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হতো। তাই এই দুষ্টচক্রটি নানাভাবে চেষ্টা তদবির করে এবং কোটি কোটি টাকা উৎস পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একটি চক্র এই প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করতে সফল হয়েছে। 


একাধিক কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। এই দুষ্টচক্রটি হলো আলোচিত মিঠু ঠিকাদারের লোক। এই মিঠু ঠিকাদার স্বাস্থ্য খাত ছাড়াও অন্য প্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তাকে আমেরিকা-কানাডার মতো দেশে বাড়ি ক্রয় করে দিয়েছেন—এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। এই দুষ্টচক্রই এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার জন্য দায়ী। এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার পর একশ্রেণির ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে নিম্নমানের স্যালাইন ক্রয় করছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কিংবা স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই চক্রটি এখন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।  

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ক্যানসার হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট, মুগদা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট থেকে যখন স্যালাইন সরবরাহ করা হতো, তখন কোনো অভিযোগ ছিল না। ঐ স্যালাইনের মান ছিল আন্তর্জাতিক। কিন্তু বর্তমানে যে স্যালাইন সরবরাহ করা হয়, তা নিম্নমানের। অনেক ক্ষেত্রে স্যালাইন দেওয়ার পর রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেটা ঠিক করতে আবার ইনজেকশনও দেওয়া লাগে রোগীদের। সিনিয়র চিকিৎসকরা জনস্বার্থে স্যালাইন তৈরির দায়িত্ব আবার পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের ওপর দেওয়ার দাবি জানান।

ছবি: আব্দুল গনি

পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে স্যালাইন তৈরির অভিজ্ঞ জনবল এখনো রয়েছে। এখনো তারা বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। কোটি কোটি টাকার উন্নতমানের যন্ত্রপাতিও রয়েছে। এই বিষয়ে মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেজন্য একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছেন। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা বাস্তবায়ন করার জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছেন।

শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (এক দিনে) সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড ৩ হাজার ১২২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৪৯ জন আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ২৭৩ জন। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ রোগী ছিল গত ১০ সেপ্টেম্বর, ঐ দিন রোগী ছিল ২ হাজার ৯৯৩ জন। এদিকে গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে পেঁয়াজ পর্যাপ্ত থাকলেও সংকট দেখা দেয়। স্যালাইনের সংকট কৃত্রিম উপায়ে তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। স্যালাইনের সরবরাহ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছেন, ১০০ টাকার স্যালাইন ৪০০ টাকা রাখছে, স্টকে থাকলেও বলছে নাই। জাতীয় দুর্যোগে যারা এসব কাজ করে তারা তো দেশপ্রেমিক না। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইভি ফ্লুইড দেওয়া, এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ সময়ে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। আমরা সিভিল সার্জনদের নির্দেশনা দিয়েছি কেউ যদি স্যালাইনের দাম বেশি রাখে, তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের স্যালাইনের সংকট হয়নি। বাংলাদেশে পেঁয়াজের মজুত থাকলেও সংকট দেখা দেয়। সিন্ডিকেট আর্টিফিশিয়ালি যে সংকট তৈরি করতে চায় তা যেন তারা না করতে পারে, সেজন্য আমরা বিদেশ থেকে ৩ লাখ স্যালাইন আমদানি করছি।

ইত্তেফাক/এমএএম