রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কে চাহে শোষিত হইতে, নিয়ন্ত্রিত হইতে?

আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৩০

জোট বা ঐক্যের নিঃসন্দেহে গুরুত্ব রহিয়াছে। বিশ্বের বিভিন্ন অংশ লইয়া বিবিধ জোট তৈরি হইয়াছে এবং সময়ে সময়ে নূতন নূতন জোট তৈরি হইতেছে। এমনই একটি জোটের সম্মেলনে বলা হইয়াছে যে, গুটিকয়েক সমৃদ্ধিশালী দেশ তাহারা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করিয়া যাইতেছে। বিশ্বকে চালাইতেছে তাহাদের হাতের ইশারায়; কিন্তু আর বেশি দিন এই নিয়ম চলিতে দেওয়া যাইবে না বলিয়া মন্তব্য করা হইয়াছে সেই সম্মেলনে। বিশ্বব্যবস্থার নিয়মের খেলাটা এখনই ঘুরাইয়া দেওয়া উচিত বলিয়া মনে করেন তাহারা।

বিষয়টিকে আমরা একটি তত্ত্বীয় জায়গা হইতে বুঝিবার চেষ্টা করিতে পারি। প্রথম কথা হইল, কেহ কি অন্য কাহারো বশ্যতা মানিয়া লইতে চাহে? অন্যের অধীনে পদানত হইয়া থাকিতে চাহে? নিজের রিসোর্স অন্যের নিকট তুলিয়া দিতে চাহে? না, কখনই চাহে না। আসলে মানবসভ্যতা গড়িয়াই উঠিয়াছে অধিকতর শক্তিধরদের দ্বারা শাসিত হইবার মাধ্যমে। যখন মানুষ কোনো অস্ত্রের ব্যবহার শিখে নাই, তখনো মানুষ একে-অন্যের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করিয়াছে। যখন একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে নূতনত্বর অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহারা সেই অস্ত্রের শক্তিতে অন্য গোষ্ঠীকে শাসিত করিয়াছে। এমনি করিয়া লৌহ, ব্রোঞ্জ, তাম্রযুগ আসিয়াছে, যাহারা বারুদের-কামানের কিংবা নূতন কোনো অভিনব যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার সর্বাগ্রে শিখিয়াছে, তাহারাই অন্যদের শাসন করিয়াছে। এইভাবেই যুগে যুগে গড়িয়া উঠিয়াছে উপনিবেশ। সেইগুলি কখনো সখনো হাতবদল হইয়াছে প্রবল যুদ্ধের মাধ্যমে। বারংবার বদল ঘটিয়াছে পৃথিবীর মানচিত্রের। যুদ্ধে কোনো না কোনো পক্ষ অবশ্যই লাভবান হয়; কিন্তু ক্ষতি হয় মানবসভ্যতার, মানবতার। তাহাতে অবশ্য বিজয়ীপক্ষের কিছু আসে যায় না। ইহা কোনো সস্তা আবেগের জায়গা নহে; কিন্তু আমরা অনেকে আবেগ দ্বারা তাড়িত হইয়া বলিয়া বসি—অনেক হইয়াছে, আর নহে, আর আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাইবে না। কথাটি এমন যেন—এতদিন আমরা ইচ্ছা করিয়াই শোষিত হইয়াছি, নিয়ন্ত্রিত হইয়াছি।

ইহা কি আমাদের অজ্ঞতা নহে? আসলে নিজেদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আমরা কি আমাদের সীমাবদ্ধতা বুঝিতে পারি? অনেকেই কিছুমাত্র বিদ্যা অর্জন করিয়া নিজেকে জ্ঞানের সমুদ্রে তালেবর বলিয়া মনে করেন। এই ক্ষেত্রে আমরা মহামতি সক্রেটিসের একটি ছোট্ট উক্তি স্মরণ করিতে পারি। তিনি বলিয়াছেন—‘সত্যিকারের জ্ঞান আমাদের সকলের নিকটই আসে, যখন আমরা বুঝিতে পারি যে আমরা আমাদের জীবন, আমাদের নিজেদের সম্পর্কে এবং আমাদের চারিপাশে যাহা কিছু আছে তাহার সম্পর্কে কত কম জানি।’ সক্রেটিসের এই কথার মতোই বলিতে হয়—আমরা অজ্ঞ। আমাদের জ্ঞানচক্ষু সামান্যই খুলিয়াছে। তিনি আরও বলিয়াছেন—“অতএব সেই ব্যক্তি জ্ঞানী যিনি তাহার অজ্ঞতার ‘রকম ও পরিমাণ’ জানেন।” কিন্তু যাহারা নিজেকে জানেন না, তাহারা নিজের অজ্ঞতাও জানেন না। সুতরাং আমরা পুনর্বার উচ্চারণ করিতে চাই সেই বিখ্যাত উক্তি—‘নো দাইসেল্ফ’—নিজেকে জানো। আমরা যদি আমাদের সীমাবদ্ধতা না বুঝি তাহা হইলে আমরা যাহা নই, নিজেদের তাহাই ভাবিব। ইহাই অজ্ঞতা।

ইহা ঠিক যে, আমরা কেহই শোষিত বা নিয়ন্ত্রিত হইতে চাহি না; কিন্তু আমাদের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে কি? মহান সৃষ্টিকর্তাই আমাদের সম্মান প্রদান করেন; কিন্তু আমরা কি কখনো ভাবিয়া দেখিয়াছি—কেন তিনি সম্মান দেওয়ার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাহা আবার ফিরাইয়া নেন? ইহা বুঝিতে হইলেও সর্বপ্রথম নিজেকে জানিতে হইবে, নিজেকে বুঝিতে হইবে। নিজেকে জানাটা সাময়িক কোনো বিষয় নহে। বরং নিজেকে জানার নিরন্তর চেষ্টা মানুষকে আমৃত্যু করিয়া যাইতে হয়। মহামতি গৌতম বুদ্ধ এই ক্ষেত্রে বলিয়াছেন যে, ‘নিজেকে তো বটেই মহাবিশ্বের যে কেহ আপনার অনুগ্রহ ও ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত না হন।’ ইসলামের দৃষ্টিতেও বলা যায়—যে নিজেকে জানিল, সে তাহার রবকে জানিল। অর্থাৎ, নিজেকে না জানিতে সৃষ্টিকর্তাকেও জানা যায় না। এই সকল বুঝিতে হইলে নিজেকে নিজের ‘সময়’ দিতে হইবে, ধৈর্য ধারণ করিতে হইবে। সমাজ-রাজনীতি হইতে শুরু করিয়া ব্যক্তিজীবন—কোথাও ধৈর্যহারা হইলে চলিবে না।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন