মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

অপরিকল্পিত পরিবহনব্যবস্থার বিপদ

আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৩০

যানবাহনব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে একটি শহরের চরিত্র অনুধাবন করা যায়। যে শহর যত উন্নত তার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম তত উন্নত। পরিকল্পিত যানবাহনব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো শহর উন্নত শহরের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে রাজধানী ঢাকা শহরের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। রাজধানীর জনসংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, রাজধানী শহর ঢাকা যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে, জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছে পরিবহনব্যবস্থা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক এবং যুগোপযোগী হতে পারেনি।

বর্তমানে রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা একটি অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দেয়। পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত, সেই সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। সড়ক নির্মাণকারী, যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানকারী ও সড়ক দেখভালকারী সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় লক্ষ করা যায় না। একটি সংস্থার কাজের সঙ্গে অন্য সংস্থার কোনো বোঝাপড়া নেই। সিটি করপোরেশন রাস্তা নির্মাণ করছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিএ) গাড়ির লাইসেন্স দিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গাড়ি আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। তারা নির্ধারণ করছে শহরে চলাচলের জন্য কতসংখ্যক গাড়ি আমদানি করতে হবে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানে না যে, বিআরটিএর সক্ষমতা কতটুকু আছে। সিটি করপোরেশনের জানার কথা তাদের নির্মিত সড়কের ধারণক্ষমতা কতটুকু। কিন্তু তারা গাড়ি আমদানির বিষয়ে কিছুই জানে না। যেহেতু এই সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই, তাই দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার শহরের রাস্তাগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করছে। ফলে সড়কে বিশৃঙ্খল পরিবেশে তৈরি হয়েছে। যানবাহন ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়েছে।

গত এক-দেড় দশকে আমাদের রাস্তার গাড়ির যে গড় গতিবেগ, তা কমতে কমতে এখন হাঁটার যে গড় গতিবেগ, তারও নিচে নেমে গেছে। একদিকে আমরা সড়ক উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছি। কিন্তু সড়কের গড় গতিবেগ কমে যাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। সমন্বয়হীনতার কারণে সড়ক উন্নয়নে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও তা তেমন কেনো সুফল দিচ্ছে না। বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যেখানে পরিবহন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং উন্নতমানের। পিক আওয়ারে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য সেখানে চলাচলের গতিবেগ কমে আসে। তবে তারা উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পিক আওয়ারের গতিবেগ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসে। সাধারণত সকালের দিকে এবং বিকেলে অফিস ছুটির সময় সড়কে যানবাহনের চাপ কিছুটা বেশি থাকে। উন্নত দেশগুলোতে পিক আওয়ারের সময়ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সড়কের গতিবেগ ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার ধরে রাখতে পারে। আর সাধারণ সময়ে তাদের সড়কের গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত তারা ধরে রাখতে পারে। রাজধানী শহর ঢাকায় পিক আওয়ারে যানবাহনের গতিবেশ ঘণ্টায় মাত্র ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। আর রাস্তায় যখন ভিআইপি চলাচল করে, তখন গতিবেগ আরো অনেকটাই কমে যায়। আমি বলব, ‘আমাদের দেশের ভিআইপি মুভমেন্ট অত্যন্ত অপরিকল্পিত। যারা নগরবাসী আছেন, নিত্যদিন রাস্তায় চলাচল করতে হয় তারা আগে থেকে জানতে পারেন না কোন রাস্তায় কখন ভিআইপি মুভমেন্ট হবে এবং রাস্তা বন্ধ থাকবে। তারা যদি আগে থেকে ভিআইপি মুভমেন্টের ব্যাপারটি জানতে পারতেন, তাহলে হয়তো কোনো বিকল্প রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারতেন।’

আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। কেউই আইন মানার ক্ষেত্রে আন্তরিক নন। শুধু চেষ্টা থাকে কীভাবে আগে যাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতি বছর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা বেশ কঠিন। প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন ঢাকা শহরে চলাচল করে এবং ঢাকার বাইরে থেকে কতসংখ্যক যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রতিদিন অন্তত ২ কোটি যাত্রা তৈরি হয়। একজন মানুষ তার বাসা থেকে কত বার রাস্তায় বের হয় এবং বাসায় ফিরে আসে, সেটাই যাত্রা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন অন্তত ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। শহরে যানজটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকার ফলে অনেকেই আর্থিক, শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যানজটের কারণে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।

এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, একটি যানবাহন যখন সড়কে চলাচল করে, তখন সড়কের ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়। কিন্তু যানবাহন জটে আটকে থাকলে রাস্তার ক্ষতি বেশি হয়। যানজটের কারণে একটি সড়কের ইকোনমিক লাইফ কমে যায়। এই চারটি খাতের ক্ষতি যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে প্রতি বছর রাজধানী ঢাকার সড়কে যানজটের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। যানজটের আর্থিক ক্ষতির এই পরিমাণ মোট জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশের মতো। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরেই যে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে তা নয়, বিভাগীয় শহরগুলোতেও যানজট নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তবে রাজধানীর বাইরের শহরগুলোতে যে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, তা এখনো ঢাকা শহরের মতো এতটা তীব্রতর নয়। তবে আগামী দিনে বিভাগীয় শহরের যানজটও আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এখনই বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজধানীতে নিত্যদিন যে অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে দেশের অর্থনীতিকে বিরাট মাশুল দিতে হচ্ছে তা সমাধানের কি কোনো উপায় নেই? রাজধানী ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহর, যেখানে চলাচলের জায়গা খুবই কম, সেখানে শুধু সড়ক অবকাঠামো তৈরি করে যানজট কোনোভাবেই নিরসন করা যাবে না। রাজধানীর সড়কে সৃষ্ট যানজট নিরসনের জন্য চাহিদার সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। আমরা সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট করছি। কিন্তু ডিম্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সেভাবে করা হচ্ছে না। আমরা নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করছি। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছি। ফ্লাইওভার নির্মাণ করছি। কিন্তু ডিম্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ওপর তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সাধারণভাবে মনে করা হয়, একটি শহরের মোট আয়তনের অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমি মনে করি, এই কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। একটি শহরের মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা দরকার, সেই শহরে যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেশি। একটি শহর টেকসই হতে পারে, যদি তার গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত এবং ভালো থাকে। আর সেই অবস্থায় শহরের মোট আয়তনের ১০ থেকে ১২ শতাংশও যদি সড়ক থাকে তাহলে সেই শহর টেকসই হতে পারে। আমাদের মাইন্ড সেটআপ পরিবর্তন করতে হবে। আমরা মনে করছি, নতুন নতুন সড়ক তৈরি করলেই যানজট কমে যাবে। কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য যদি মনোযোগী হতাম, তাহলে সমস্যা সমাধান করা সহজতর হতো। আমি মনে করি, রাজধানীতে গণপরিবহনের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে হবে। কারণ গণপরিবহন সাশ্রয়ী, টেকসই এবং সবার জন্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করে। টেকসই উন্নয়নের যেসব প্যারামিটার আছে তার মধ্যে ইনক্লুসিভনেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়িকে বিভিন্ন সময় যেভাবে উত্সাহ দেওয়া হয়েছে, যে কারণে শহরে এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাড়ির সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সৃষ্টি হয়েছে যানজটের মতো নাজুক পরিস্থিতির। ব্যক্তিগত গাড়িতে যাত্রী পরিবহন করা হয় আনুপাতিকহারে খুবই কম। কিন্তু তারা সড়কের একটি বড় অংশ জুড়ে চলাচল করে। ব্যক্তিগত গাড়িতে যাত্রী পরিবহন করা হয় ছয় থেকে সাত শতাংশ যাত্রী। কিন্তু তারা দখল করে আছে মোট সড়কের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ স্থান। গণপরিবহন ব্যবস্থা সড়কের ৫ থেকে ১০ শতাংশ স্থান জুড়ে আছে, কিন্তু তারা বহন করছে প্রায় ৩০ শতাংশ যাত্রী। আমরা যদি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারতাম, এই খাতকে যদি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ যাত্রী গণপরিবহনে যাতায়াত করতে পারত। আমাদের যে আরএসটিপি আছে সেখানেও বলা হয়েছে—রাজধানী ঢাকা শহরের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ যাত্রী গণপরিবহনে যাতায়াত করাতে পারবেন, যদি এই খাতকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি। রাস্তায় উন্নত মানের গাড়ির ব্যবস্থা করা যায়। সড়ক ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল ও নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে আসা যায়।

আমি দুঃখের সঙ্গে বলব, আমাদের ঢাকা শহরের গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে—সেই পরিকল্পনা এখনো বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সারা বিশ্বেই গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গণপরিবহন-ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার যে উদ্যোগ, তা একটি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শহরে ভালো মানের গাড়ির পাশাপাশি লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়িও চলছে। যারা বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির মালিক, তারা নানাভাবে কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দাবিদাওয়া আদায় করে নিচ্ছেন, কিন্তু যাত্রীদের কথা কেউই ভাবছেন না। সরকার যদি কোনো আইনি সংস্কার সাধন করতে যায়, তাহলে পরিবহন মালিকরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তারা আন্দোলনের হুমকি দিয়ে অথবা পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সরকারকে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেন।

রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থাকে যদি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হয়, তাহলে সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। কারো অন্যায় দাবির কাছে কোনোভাবেই মাথা নত করা যাবে না। আমাদের সবার আগে নগরবাসীর স্বার্থ চিন্তা করতে হবে। একটি আধুনিক শহরের পরিবহনব্যবস্থা যদি উন্নত ও যুগোপযোগী না হয়, তাহলে কোনোভাবেই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে যদি উন্নত করা যায়, তাহলে যাত্রীরা সেই পরিবহন ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আর একটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো—কোনোভাবেই যেন মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়ি রাজপথে চলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

অনুলিখন: এম এ খালেক

লেখক: নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন