বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ বাজার বলছে, দ্রব্যমূল্যের যে পরিস্থিতি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তাতে মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক বছরের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী এবং ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত মে মাসে (৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ)। একই মাসে গত বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। আগস্ট মাসে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। স্থানীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
২০২০ সালে খাদ্য খাতে ১০০ টাকার পণ্যে ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বেড়েছিল। একই পণ্যে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বেড়েছে ১২ টাকা ৫৪ পয়সা। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে অসহায় অবস্থায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। গত ১৫ বছরে ক্ষুধা জয়ের ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। মানুষের জীবনমান নিঃসন্দেহে বেড়েছে। তবে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির যে ভয়াল দৈত্য দেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছে, তাতে ক্ষুধার জ্বালা না বাড়লেও জীবনমান কমছে। খাদ্যপণ্যের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অন্যান্য খাতের চাহিদা অপূর্ণ থাকছে। এমনকি চিকিত্সা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। এই সংকটের সমাধান মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা। সরকারের সুনামও এর সঙ্গে জড়িত। শহর ও গ্রামের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে এর ধকল বেশি। গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এটা হচ্ছে আমাদের সার্বিক মূল্যস্ফীতির চিত্র। অন্যদিকে প্রান্তিক আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সবার আগে আমলে নিতে হয়। গ্রাম ও শহর মিলিয়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আলাদাভাবে দেখলে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি শহরের থেকে বেশি। বাস্তবতা হয়তো আরো ভিন্ন। মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, মুরগি ও ডিমের মূল্যবৃদ্ধি এর জন্য দায়ী। মূল্যস্ফীতি শিগিগরই যে নেমে আসবে, সে রকম আশাব্যঞ্জক কিছু সামনে দেখছি না।
অনেকেই মুদ্রাস্ফীতির কারণকে অনেকভাবেই বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন—বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি; দেশজ উত্পাদনে ঘাটতি; পণ্য সরবরাহে ঘাটতি; মুদ্রার বিনিময় হার; শুল্ক ও বিশেষ শুল্ক হার; অশুল্ক বাধাগুলোর প্রভাব; মুদ্রা সরবরাহ; বাণিজ্য ঘাটতি; বাজেট ঘাটতি; বিদেশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা; সুদের হার; ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণগ্রহণ; পণ্যের একচেটিয়া মূল্য নির্ধারণ; শ্রমিক ইউনিয়নের মজুরি বাড়ানোর চাপ; শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে খাতওয়ারি মজুরি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা; শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা; মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে অসামাঞ্জস্য; সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে জীবনমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার মতো কারণগুলো। বর্তমানে দেশে জিডিপির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হারের প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে গরিব মানুষের অর্ধেকের বেশি ‘?নতুন দরিদ্র’। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সপ্তম ধাপের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) ফলাফল অনুযায়ী, এই মুহূর্তে বাংলাদেশি খানাগুলোর প্রায় অর্ধেকই খাদ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। জরিপে দেখা যায়, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে সবচেয়ে বড় আর্থিক ধাক্কা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ৪৮ শতাংশ খানা। এই যে মূল্যস্ফীতি, তা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করছে। মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্তকে নামাচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্তে, আর নিম্ন-মধ্যবিত্তকে নিয়ে যাচ্ছে নিম্নবিত্তে। এতে স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
স্থানীয় অর্থনীতি এখন এমন একটা পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে ছোট দোকান ও কৃষিজমির মালিক কিংবা শিল্প ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বল্প দক্ষ কর্মীদের জীবন সহজ না হলেও ঘরে তাদের পর্যাপ্ত খাবার থাকে। তারা আয়ের অর্ধেক অর্থ মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ব্যয় করে। অন্যান্য অনেক কেনাকাটা সেকেন্ড হ্যান্ড বা অনানুষ্ঠানিক বা খোলাবাজার থেকে করেন। কিন্তু এই গোষ্ঠীর উত্তরণের স্বপ্ন খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। স্থানীয় পণ্যের উচ্চমূল্য ও মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, এটি মনে রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতির চাপ আরো কিছু সময় থাকবে। এটি সারা পৃথিবীতেই অনুভূত হচ্ছে।
উপরোক্ত পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে দুটি বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এর জন্য দেশের ভেতরে উত্পাদিত পণ্য ও আমদানিকৃত পণ্যের সংগ্রহ বাড়াতে হবে; দ্বিতীয়ত, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের লোকদের সহায়তা দিতে হবে, যাতে তারা বাজার থেকে পণ্য কিনতে পারে। তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। এছাড়া ক্ষদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কার্যক্রমের জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন, যার জোগান কে দেবে? তাই সরকারকে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। যেমন—আমাদের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ খুবই কম, যা বর্তমানে কর-জিডিপির হার মাত্র ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিম্নতম। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন না বাড়ালে উন্নয়ন কার্যক্রমে এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে পারব না। তার পরের বিষয়টি হলো সুশাসন। অর্থ্যাত্ সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে; অপ্রয়োজনীয় খরচ, প্রকল্প বাস্তবায়নে অপচয় রোধ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এরই মধ্যে ব্যয় কমানোর ব্যাপারে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। সেগুলো ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আরো সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং রপ্তানি আয় সে তুলনায় বাড়ছে না, রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়ছে না।
অতএব, মূল্যস্ফীতি না কমালে স্থানীয় অর্থনীতি আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা, টিসিবি, পণ্য বিপণন ব্যবস্থাপনা, চাহিদা সরবরাহ নেটওয়ার্ক এবং সর্বোপরি আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আনয়নপূর্বক এই সমস্যা সমাধানে তত্পর হতে হবে। অধিকন্তু, বিভিন্ন বাজার কমিটি দ্রব্যসামগ্রীর গুণাগুণ যাচাই কমিটি, মালামাল সংরক্ষণ ও গুদামজাত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি মহানগর ও পৌর এলাকাস্থিত বাজারগুলোতে তাদের নিজস্ব পরিদর্শন টিমের আন্তরিকতার সঙ্গে তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক। সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা