সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

অর্থপ্রতারণা: এখনো ফিরিতেছে না হুঁশ

আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৩০

উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ হিসাবে বাংলাদেশেও যে নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা রহিয়াছে তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয়, আমাদের উল্লেখযোগ্য প্রধান সমস্যা অসচেতনতা, অজ্ঞতা ও বোকামি। আমরা একই ধরা বারংবার কীভাবে খাই? বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এমএলএম বা হায় হায় কোম্পানি বা সংস্থার হস্তে অর্থকড়ি দিয়া আমরা প্রতারিত হই, সর্বস্বান্ত হই। দেশে একের পর এক ঘটিতেছে এমন দুঃখ ও লজ্জাজনক ঘটনা। তাহার পরেও আমাদের বোধোদয় হইতেছে না, ফিরিতেছে না হুঁশ। লোভে পড়িয়া শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ঘটিবাটি, গয়নাগাটি ইত্যাদি বিক্রয়পূর্বক বিনিয়োগ করিয়া সর্বস্ব হারাইতেছেন। সর্বশেষ জানা গেল অ্যাপের মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা লইয়া লাপাত্তা হইয়া গিয়াছেন এক চীনা নাগরিক। শুধু কি চীনা নাগরিক, আমরা বাংলাদেশে আসা প্রতারক চক্র একশ্রেণির আফ্রিকান নাগরিকদের হাতেও নাকানি-চুবানি খাইতেছি। প্রবাদে আছে যে, চোর পালাইয়া যাইবার পর বুদ্ধি বাড়ে। কিন্তু আমাদের তাহাও বাড়ে না। কেবল হাপিত্যেশ করিয়া যাইতেছি।

৩০০ কোটি টাকা তো সামান্যই। কিছুদিন আগে এমটিএফই নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল কারসাজিতে পড়িয়া ৭০ হাজার গ্রাহকের ১১ হাজার কোটি টাকা নাই হইয়া গেল মুহূর্তের মধ্যে। মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধন, ডলার কিনিয়া কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার হাতছানি—এমন লোভের বার্তা এক কান-দুই কান হইতে শত শত মানুষের কানে পৌঁছাইয়া যায়। ইহার পর একদিন দেখা গেল কোম্পানি উধাও, বন্ধ অ্যাপও। আলোচ্য ঘটনায় দেখা যাইতেছে, চীনা নাগরিকটি মোবাইল ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে প্রতারণার ফাঁদ পাতিয়াছিল। সেইখান হইতে একটি লিংক ক্লিক করিলেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বরগাটা নামক একটি অ্যাপ নামাইয়া সেখানে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করিলেই আয় হইবে দৈনিক ৮০০ টাকা হইতে ৫ হাজার টাকা। সকল কিছু যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পাইবার মতো। প্রশ্ন হইল, এমন অফার কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য হইতে পারে? আবার বাংলাদেশি একজন মৃত ব্যক্তির নামে কীভাবে খোলা যায় মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট? অর্থ বিনিয়োগের আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ইত্যাদির বিস্তারিত খোঁজখবর করা কি বাঞ্ছনীয় নহে? অনেক সময় ব্যাবসায়িক অংশীদার বানানো, জনপ্রতিনিধিদের বিদেশি সহায়তা ইত্যাদির নামেও প্রতারণা চলিতেছে। ইহার পিছনে অজ্ঞতা ছাড়াও কাজ করে লোভ। অতিরিক্ত লোভ মানুষকে করিয়া ফেলে দিশাহারা। ডাকিয়া আনে সর্বনাশ। কথায় বলে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। কিন্তু কে শোনে কাহার কথা? বাংলায় আরেকটি প্রবাদ রহিয়াছে, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। এই সকল নীতিবাক্য আমরা বাল্যশিক্ষার বইতে বহুবার পাঠ করিয়াছি। কিন্তু তাহা হইতে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করি নাই।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রথম এমএলএম তথা মালটি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি হিসাবে জিজিএন বা গ্লোবাল গার্ডিয়ান নেটওয়ার্কের আবির্ভাব হয় ১৯৯৮ সালে। ইহার পর পর্যায়ক্রমে টংচং, ডেসটিনি, ইউনিপে, নিউওয়ের মতো প্রতিষ্ঠান একই মডেলে ব্যবসা খুলিয়া বসে। তাহারও আগে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক প্রায় একই পদ্ধতিতে দেশব্যাপী কার্যক্রম শুরু করে। এখন লেনদেন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হইয়াছে। প্রতারণাও ডিজিটাল রূপ ধারণ করিয়াছে। কিন্তু ইহা বুঝিতে তথ্যপ্রযুক্তিগত যে জ্ঞান-গরিমা দরকার, তাহা অনেক সময় তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরও থাকে না। দেখা যাইতেছে, এমটিএফই অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ের আশ্রয় লইয়াছে। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ। আমরা ভুলিয়া যাই নাই যে, অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করিয়াই গত পাঁচ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতাইয়া নিয়াছে ইভ্যালি, ধামাকা, দালাল, ই-অরেঞ্জ, অ্যালেশামার্টের মতো অন্তত ১৭টি প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ গ্রাহকরা তাহার কোনো প্রতিকার পান নাই, ফেরত পান নাই তাহার হারানো ও কষ্টার্জিত অর্থ। এমন প্রতারণার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের সম্মুখেই ঘটিতেছে। কিন্তু কেহই আগেভাগে প্রশ্ন তুলিতেছেন না বা ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেছেন না কেন? ইহা বন্ধ করিতে হইলে জনসচেতনতার পাশাপাশি আর্থিক অপরাধ শনাক্ত এবং ইহার প্রতিরোধে মজবুত ব্যবস্থাপনা গড়িয়া তুলিতে হইবে। দেশি বা বিদেশি কিংবা প্রভাবশালী বা অপ্রভাবশালী যে-ই হউন না কেন, এমন প্রতারকদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করিতে হইবে আইনানুগ ব্যবস্থা।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন