রোববার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কথা বরং কম বলা ভালো

আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৩০

আব্রাহাম লিংকন বলিয়াছিলেন, ‘আপনি কিছু সময় কিছু লোককে মিথ্যা কথা বলিয়া বোকা বানাইতে পারেন, কিন্তু সকল সময় সকলকে বোকা বানাইতে পারিবেন না।’ কথাটি প্রায় দেড় শত বছর পূর্বের। তখন সত্য আড়াল করা তুলনামূলক কিছুটা সহজ ছিল। কিন্তু এই আধুনিক যুগে তথ্যের আড়াল রাখা অসম্ভব প্রায়। এই যুগে কোথায় কী ঘটিতেছে, কী উদ্দেশ্যে কোন ছবি বিকৃত করা হইয়াছে, কে বা কাহারা করিয়াছে, কীভাবে তথ্যের অতিরঞ্জন ঘটানো হইতেছে—এই ধরনের সাধারণ তথ্য এখন বিস্ময়কর তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে খুব সহজেই যাচাই করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, যেই সত্য দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট, তাহাকে আড়াল করিয়া কেন এত মিথ্যার বেসাতি? আমরা ছোট্ট একটি সংবাদের শিরোনামের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে পারি। ‘পক্ষপাতমূলক আচরণ চাই না’, কথাটি শুনিতে নিঃসন্দেহে খুব ভালো। যাহাদের কাজ সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখিয়া লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা—তাহাদের নিকট হইতে তো পক্ষপাতমূলক আচরণ কাম্য নহে। সুতরাং যখন বলা হয় ‘পক্ষপাতমূলক আচরণ চাই না’—তখন তাহা শুনিতে অনেকটাই নিষ্পাপ শিশুর নিষ্কলুষ বুলির মতো শুনায়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? যাহারা সম্প্রতি নির্বাচনের মাঠের ঘাসে পা রাখিয়াছেন, তাহারা দেখিয়াছেন সেইখানে ঘাসের জায়গায় কত ধরনের কাঁটা বিছানো। এই ক্ষেত্রে ছোট্ট একটি উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে।

দুই মাস পূর্বে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি উপজেলায় পৌর নির্বাচনের অনিয়ম লইয়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিস্তর সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে। সেই সকল সংবাদে দেখা গিয়াছে, ঐ এলাকায় বিপথগামী লোকদের মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হইয়াছিল। ‘উঠান বৈঠকের’ নামে পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলা হইতে লোক ভাড়া করিয়া আনিয়া উত্তেজনামূলক বক্তব্য দেওয়া হইয়াছিল—যাহা এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সেই সকল প্রকাশিত সংবাদে বলা হইয়াছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় সন্ত্রাসীরা গাড়িবহর লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইলেও, নির্বাচন আচরণবিধি বারবার লঙ্ঘন করা হইলেও, প্রশাসন হইতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। স্বাভাবিকভাবে ভীতিকর পরিবেশের চিত্র দেখিয়া ভোটাররাও হতাশা হইয়াছিলেন। অথচ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করিবার জন্য সকল পর্যায় হইতে ঘোষণা দেওয়া হইয়াছিল—‘যে কোনো মূল্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা হইবে।’

প্রশ্ন হইল—এই ধরনের ঘোষণা কি কেবল বাত-কা-বাত? নচেৎ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বহারা দলের সাজাপ্রাপ্তদের ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করিয়া আনিবার সংবাদ আমাদের পড়িতে হইবে কেন? মাদক বিক্রির টাকা ছড়াইয়া এলাকার যুবসমাজকে নষ্ট করিবার খবর বারংবার দেখিতে হইবে সংবাদপত্রে? সবচাইতে ভয়ংকর ব্যাপার হইল, সেই নির্বাচনের আগের দিন রাতে পাঁচটি কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরার লাইন কাটিয়া ইভিএমে ভোট কারচুপি ঘটানো হইয়াছে—যাহা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে অকপটে স্বীকার করিয়াছেন। সিসি ক্যামেরার লাইন কাটা পাঁচটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখিবার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন তখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিতেন, কিন্তু তাহা করা হয় নাই। বরং এই ‘বল’ অন্য কোর্টে ছুড়িয়া দেওয়া হইল, সেই ‘বল’ গিয়া পড়িল আরও দূরে, এবং তাহার পর উহা এক অর্থে হিমাগারে চলিয়া গেল।

এই যদি হয় স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনি হাঁড়ির মধ্যকার একটি চাউলের চিত্র, তখন সামগ্রিক চিত্র সহজেই অনুমেয়। এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের কি বেশি কথা বলা উচিত? তাহা কি শোভা পায়? আগেকার দিনের বেশির ভাগ মা তাহার ছোট্ট শিশুটির চোখে কাজল পরাইয়া দিতেন। তাহাতে অন্তত ঐ শিশুটির মধ্যে চক্ষুলজ্জা বলিয়া একটি ভালো গুণ তৈরি হইত। এখন বেশির ভাগ মা তাহাদের বাচ্চাদের চোখে আর কাজল পরান না। সেই জন্য মানুষের মধ্যে চক্ষুলজ্জাও যেন এখন ক্রমশ কমিয়া গিয়াছে। ঢাকাইয়া কুট্টিদের মতো আমাদের মনেও কথাটি গুঞ্জরিত হয়—‘আস্তে কন হুজুর, হুনলে ঘোড়ায় ভি হাসব!’ যেই কথা শুনিয়া ঘোড়াও হাসিবে, সেই কথা বলিবার দরকার কী? কী দরকার এইভাবে মানুষ হাসানোর? কথা বরং কম বলা ভালো।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন