ঢাকার ধামরাইয়ের পাল্লি গ্রামের আবুল কালাম আজাদ দীর্ঘদিন ধরে তার ৪০ শতাংশ জমি বর্গার মাধ্যমে চাষাবাদ করান। হঠাৎ একদিন রাতে তার জমিতে ভেকু দিয়ে মাটিকাটা শুরু হয়। পরদিন তিনি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি জানান। সেসময় জমির মাটিকাটা বন্ধ হলেও বেশ কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে মোবাইল ফোনযোগে হুমকি দিতে থাকেন। পরে তিনি স্থানীয় ধামরাই থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাতেও কোনো সুরাহা হয়নি।
আবুল কালাম অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত কাজে তিনি ঢাকায় এলে চলতি বছর ২০ জানুয়ারি রাতে ভেকু দিয়ে জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যায়। জমিতে একটা ছোটখাটো পুকুর হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি ওই জমিতে চাষাবাদ করতে পারেননি।
আবুল কালামের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা ধামরাই থানার কুল্লা ইউনিয়নের পাল্লি গ্রামের অনেকের। ইটভাটা মালিকদের কারণে এভাবে ৩০ জনের বেশি জমি মালিক সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। তাদের জমিতে ছোট পুকুর হয়ে গেছে।
বংশী নদীর কোল ঘেঁষা এই পাল্লি গ্রামসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা ভালো নেই। দিনে দুপুরে ভেকু দিয়ে কৃষকদের তিন ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাওয়ায় চাষের যোগ্যতা হারিয়েছে জমি। এক সময় মাঠের ফসলে হাসি ফুটলেও সেটি এখন অতীত। এখন মাঠ জুড়ে শুধু বড় বড় গর্ত।
গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, জমির মাটি কাটায় বাধা দিলেই প্রভাবশালীরা পুলিশ ডেকে নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। তারা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেয়। বারবার লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও অজানা কারণে ব্যবস্থা নিচ্ছে না উপজেলা প্রশাসন।
আইন অনুযায়ী কোনো ইটভাটার ১ কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই ইট ভাটা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া, ইটের কাঁচামালের জন্য ফসলি জমির মাটি ব্যবহার করা যাবে না। অথচ পাল্লি গ্রামের ১ কিলোমিটারের ভেতরে দুটি প্রাথমিক স্কুল, স্বাস্থ্য সেবার কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাল্লি গ্রামের প্রবেশ মুখে একটি ইটভাটা। মাহী ব্রিকস নামের ইটভাটার চারপাশে কৃষি জমি। ভাটা লাগোয়া জমিতে মজুদ করা লাখ লাখ ইটের পাহাড়। পাশেই ফসলি জমি থেকে কেটে আনা মাটির পাহাড়। আর দানবাকৃতির কয়েকটি ভেকু। এগুলো দিয়ে গত চার বছর ধরে কৃষকের সোনালি ফসলের মাঠ ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে। ভাটা থেকে ১০০ মিটার দূরে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের ওপারে নিচু জমি। পানিতে ভরা। মনে হচ্ছে, এটা পুকুর।
গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ইউনুস আলী বলেন, ‘গত বছরও জমিতে ধান চাষ হয়েছিল। এ বছর জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নেয়া হয়েছে। এখন পুকুর।’
তিনি আরও বলেন, ‘চার বছর আগে পাশের ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলাইমান পাল্লি গ্রামের প্রধান সড়ক লাগোয়া কয়েক বিঘা জমি কিনে মাহী ব্রিকস নামের ইটভাটা গড়ে তোলেন। এরপর ধীরে ধীরে গ্রাস করা শুরু করেন চাষের জমি। প্রথমে টাকার প্রলোভন দিয়ে অল্প কিছু জমি কেনেন। এরপর সেই জমির মাটি গভীর করে কেটে নিয়ে যান। ফলে পাশের জমি ভেঙে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর এই সুযোগে অল্প দামে ওইসব জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষকরা। এভাবে কয়েক বছরে শতাধিক বিঘা জমি কিনেছেন। পাশের গ্রামে সরকারের সংরক্ষিত বিটলা বিলের মাটিও কেটে নিয়ে ইটভাটায় ব্যবহার করা হয়েছে।’
ইত্তেফাকের এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে পাল্লি গ্রামে ক্ষতিগ্রস্থ জমির কয়েকজন মালিক ও কৃষক জড়ো হন। তবে তারা কথা বলতে চান না। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন যে সংবাদপত্রে নাম প্রকাশ হলেই পরদিন হুমকি-ধামকি দিয়ে গ্রামছাড়া করবে প্রভাবশালীরা।
পাল্লি গ্রামের বাসিন্দা কিবরিয়া (ছদ্মনাম) বলেন, ‘ইটভাটার কারণে এখন আগের মতো ফসল হয় না। ধান চাষের খরচই ওঠে না। অথচ কখনও কখনও তিন ফসল, কখনও কখনও চার ফসল পেতাম। এখন জমির উপরিভাগ সমান মাটি নেই। স্থানে স্থানে গর্ত। তাই চাষাবাদ করা যায় না। এমনকি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক চলাচলের কারণেও বহু জমি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব জমি মাটি ট্রাকের চাকার কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া ফসল হয় না।
অপর এক বাসিন্দা রাশেদ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘ভাটায় যখন কয়লা আর টায়ার পোড়ায় তখন বাতাস বিষাক্ত হয়ে যায়। ধানের শিষ পুড়ে যায়। গ্রামের অন্যসব ফল গাছের ফল অকালে পেকে পড়ে যায়।’
কৃষি জমির মাটি কেটে নেওয়ার বিষয়ে জানতে ইটভাটা মালিক সোলাইমান ইসলাম বলেন, ‘আমি কারো জমি দখল করে মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার করিনি। একজন ব্যক্তি তার জমি দখল হয়ে যায়। আমি তার পক্ষে কোনো কথা বলিনি বলে ওই ব্যক্তি প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ইট প্রস্তুত আইন বিবেচনা করে ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর আইন এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স এই দুটো নিয়েই কিন্তু ইটভাটা পরিচালনা করতে হয়। এটা সত্য যে, যে শর্ত দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হয়, ইটভাটার মালিকরা অনেক সময় সেসব শর্ত পালন করেন না। গত বছর প্রায় তিনশতধিক ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। চলতি বছর এরই মধ্যে কয়েক শ’ ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফসলের মাঠের জমি কাটাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে গত মার্চে মাহী ব্রিকস নামের ইটভাটাটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানাও করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আগস্টে ইটভাটা মালিক সোলাইমান ইসলামকে পরিবেশ অধিদপ্তর ডেকেছিল। কিন্তু তিনি হাজির হননি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, ‘যেখানে মানুষ অভিযোগ করছে ও ইটভাটা বন্ধের আবেদন জানাচ্ছে এবং যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেও বলছে যে তারা জরিমানা করেছে সেখানে এই ইটভাটা বন্ধ করে দিতে তো সমস্যা নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর দুটো কারণে পিছিয়ে আসতে পারে। যদি কোন রাজনৈতিক প্রভাব থাকে অথবা যদি কোন অবৈধ যোগসাজশ থাকে। কিন্তু যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি জানে এবং এই ইটভাটার মালিককে যেহেতু তারা ডেকেও নিয়েছে, তাহলে বলা যায় যে এই ইটভাটার কারণে পরিবেশের হুমকির মুখে পড়ার দায় পরিবেশ অধিদপ্তরের এবং জেলা প্রশাসনের।’