দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলিয়াছেন, ‘শান্তিতে বসবাস করিবার জন্যই যুদ্ধে লিপ্ত হই আমরা।’ এই কথার ঠিক বিপরীতে অবস্থান নেপোলিয়ানের। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, ‘যুদ্ধ হইল বর্বরদের ব্যবসা।’ বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরিখে হিসাব করিলে শেষোক্ত বাক্যকেই গ্রহণ করিতে হয়। যুদ্ধবিগ্রহের শিকারে পরিণত হইয়া আজিকার বিশ্ব যেইভাবে ধুঁকিতেছে, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে বলিতে হয়, কোথায় গিয়া পরিসমাপ্তি ঘটিবে এই মহাসংকটের? দেড় বত্সরের অধিক কাল পার হইয়াছে, যুদ্ধ চলিতেছে সার্বভৌম ইউক্রেনের মাটিতে। দুঃখজনকভাবে এই সংঘাত কেবল নূতন নূতন বাঁকই লইতেছে; সংঘর্ষ শেষ হইবার লক্ষণ মাত্র নাই! অতীতে এমন বহু যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে—কোনো কোনো সংঘাত শত বত্সরের মাথায় গিয়া শেষ হইয়াছে; কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সম্ভবত দেখা যায় নাই পূর্বে! আজিকার বিশ্বের জটিল সমীকরণে বাঁধা পড়িয়া যুদ্ধ যেন হইয়া উঠিয়াছে একধরনের ‘খেলা’। আর দিন শেষে এই খেলায় অবধারিতভাবে পরাজিত হইতেছে বিশেষ করিয়া উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের বড় ভুক্তভোগী দরিদ্র দেশগুলি, ইহাই বাস্তবতা। কী দেখায় নাই এই যুদ্ধ আমাদের! উন্নয়নশীল বিশ্ব তো বটেই, ভূরাজনীতির বলি হইয়া রীতিমতো জ্বলিতেছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলিও।
ইউক্রেন যুদ্ধকে যেন জিয়াইয়া রাখা হইতেছে! এক পক্ষ চাহিতেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিজয় পুষ্পমাল্য গলায় পরিতে। অন্য পক্ষও পড়িয়া রহিয়াছে মাটি কামড়াইয়া। দুই পক্ষকেই আবার আড়াল হইতে রসদ জোগাইতেছে স্ব-স্ব ‘মিত্র শক্তি’! রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ শুরুর মাস কয়েক পর হইতেই হুংকার ছাড়িয়া আসিতেছেন, ‘পারমাণবিক বোমা পড়িল বলিয়া!’ পালটা হুঁশিয়ারি আসিতেছে বিপরীত পক্ষ হইতেও। তবে পশ্চিমারা চাহিতেছে, এই যুদ্ধ যেন কোনোক্রমেই পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত না হয়। এইভাবেই নিকষ অন্ধকারে আচ্ছাদিত হইতেছে ইউক্রেন সংকট। এবং এই সংকটের অভিঘাত আছড়াইয়া পড়িতেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। ইহার ফলে কী ঘটিতেছে? বিশ্ব অর্থনীতি ভাঙিয়া পড়িয়াছে। সর্বক্ষেত্রেই যেন ‘নাই নাই’ অবস্থা। দরিদ্র দেশগুলিকে তাকাইয়া থাকিতে হইতেছে কৃষ্ণসাগরের দিকে! পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পালটা ব্যবস্থা হিসাবে রাশিয়ার অবরোধের কারণে সাগরে আটকা পড়িতেছে শস্যভর্তি জাহাজ। শস্যভান্ডার খ্যাত ইউক্রেনের গুদামে যখন খাদ্যপণ্য পচিতেছে, ঠিক একই সময়ে জ্বালানি সরবরাহের পাইপলাইনে রাশিয়ার চাবি মারিবার কারণে ইউরোপীয় অঞ্চলে বন্ধ হইয়া যাইতেছে শিল্পকারখানা। সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হইয়া একদিকে খাদ্যাভাব তীব্র আকার ধারণ করিতেছে তো, জ্বালানিসংকটে মুখ থুবড়াইয়া পড়িতেছে উত্পাদন-বিপণন। এইভাবে চলিতে থাকিলে বিশ্বব্যবস্থার চাকা আর কতদিন স্বাভাবিক গতিতে চলিতে পারিবে, তাহাই বড় চিন্তা।
করোনা মহামারির অভিঘাত কাটাইয়া উঠিয়া দেশগুলি যখন একটু একটু করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইতেছিল, ঠিক সেই সময়ে শুরু হইল অস্ত্রের ঝনঝনানি। ইউক্রেন যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের পাল্লা আজ হেলিতেছে-দুলিতেছে কেবল ‘অস্ত্র-সক্ষমতা’কে কেন্দ্র করিয়া। মিত্র শক্তির সরবরাহ করা অস্ত্র, গোলাবারুদে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়াইয়া যখন বিজয় লাভের স্বপ্ন দেখিতেছে যুদ্ধকবলিত ইউক্রেন, তখন পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়াকে ‘একটি নির্ধারিত গণ্ডির’ মধ্যে আটকাইয়া রাখিতে চাহিতেছে ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলি। ইউক্রেনের হাতে এমন কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র তুলিয়া দেওয়া হইতেছে না, যাহাতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে হাঁটিতে বাধ্য হয় মস্কো। আবার এই যুদ্ধকে যে শেষ করিতে হইবে, এমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পথেও হাঁটিতে দেখা যাইতেছে না। এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও পরিণত হইয়াছে ঠুঁটো জগন্নাথে!
শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ নহে, পৃথিবীর বহু প্রান্তে আজ বিরাজ করিতেছে যুদ্ধাবস্থা। খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলিতেছে যেন! অবস্থা এমন, অতীতে দীর্ঘ সময় ধরিয়া চলা যুদ্ধের যবনিকা পতন ঘটানো গেলেও একবিংশ শতাব্দীর সংঘাত যেন লাগামছাড়া হইয়া উঠিয়াছে! যুদ্ধ-সংঘাতের পৃষ্ঠদেশে দাঁড়াইয়া আজিকার সমাজ যেন হইয়া উঠিয়াছে ‘বর্বর-কর্কশ’। সংঘাত-হানাহানি ও যুদ্ধের মধ্য দিয়া মানবসভ্যতাকে যেইভাবে সংকটের ঘেরাটোপে ক্রমাগতভাবে নিক্ষেপ করা হইতেছে, তাহা যে বিশ্বকে বেশ ভোগাইবে, ইহা শতভাগ নিশ্চিত। বিজ্ঞানী হারবার্ট জর্জ ওয়েলসের কথাই আজ বেশি করিয়া স্মর্তব্য—‘আমরা এই যুদ্ধ শেষ না করিলে, যুদ্ধ আমাদেরকে শেষ করিয়া দিবে।’