একবিংশ শতাব্দীতে ন্যানো টেকনোলজি বা ন্যানো প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়কর পরিবর্তন এনেছে। পারমাণবিক বা আণবিক মাত্রায় অতিক্ষুদ্র যন্ত্র তৈরি করার জন্য ধাতব বস্তুকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর প্রযুক্তিকে টেকনোলজি বলে। Nano শব্দটি গ্রিক শব্দ nanos থেকে এসেছে; যার আভিধানিক অর্থ জাদুকরি ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষ। আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফেনমেন ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এক সেমিনারে ‘There’s Plenty of Room at the Bottom’ শিরোনামের এক বক্তৃতায় ন্যানো টেকনোলজির ধারণা দিয়েছিলেন। এজন্য তাকে ন্যানো টেকনোলজির জনক বলা হয়। অঙ্কের হিসাবে এক মিটারের এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এক ন্যানো মিটার। একটি চুলের ৪০ হাজার ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এক ন্যানো। ১০টি হাইড্রোজেন পরমাণু পর পর রাখলে সেটা এক ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের সমান হয়; যা খালি চোখে দেখা যায় না।
ন্যানো টেকনোলজিতে ব্যবহূত ডিভাইসগুলো খুব ছোট, কিন্তু ক্যাপাসিটি হবে অনেক বেশি। গতি ও কর্মক্ষমতাও হবে অনেক বেশি। বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় এখন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারে ওপেন হার্ট সার্জারিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে। হূিপণ্ডে ব্লক হলে সার্জারি করা হতো বা রিং পরানোর ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু এখন ধমনির ভেতর দিয়ে ন্যানো পার্টিকেল প্রবেশ করানো যায় এবং বায়োসেনসর দিয়ে বাইরে থেকে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্লকগুলো খোলা যেতে পারে। ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে উত্পাদিত ওষুধকে ‘স্মার্ট ড্রাগ’ বলা হয়। ন্যানো ফাইবার সার্জিক্যাল অপারেশনে চিকিত্সকেরা ব্যবহার করছেন। এটি শুধু অপারেশন প্রক্রিয়াকে সহজতর করছে তা নয়, বরং রোগীদের অপারেশন-পরবর্তী জটিলতা থেকেও রেহাই দেয়। চিকিত্সার প্রয়োজনে কখনো কখনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলতে হয়। তাদের জন্য কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করতে হয়।
ক্যানসার সেলে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে সুস্থ টিস্যুগুলো ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য গবেষণা চলছে। ক্যামোথেরাপির ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবের চেষ্টা চলছে। মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও টিস্যু বৃদ্ধির উপায় নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। ন্যানো প্রযুক্তির সহায়তায় জিন সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির বিকাশের সুযোগ রয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্যশস্যকে কয়েক গুণ পুষ্টিসমৃদ্ধ করা যাবে। পরিবেশে বিদ্যমান দূষিত বাতাস চিহ্নিত করতে এবং তা পরিষ্কার করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শিল্পকারখানার দূষিত পানি ন্যানো টেকনোলজি প্রয়োগ করে অল্প খরচেই পরিষ্কারকরণের কাজে ব্যবহূত হচ্ছে। ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যকে এই প্রযুক্তির সাহায্যে দূষণমুক্ত করে নদীর পানি দূষণ প্রতিরোধে সহায়তা করে। বাতাসে ও মাটিতে বিদ্যমান রাসায়নিক বা জৈবিক পদার্থ চিহ্নিত করার জন্য ন্যানো টেকনোলজি-সমৃদ্ধ সেনসর ও সল্যুশন কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কৃষিতে ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার অপচয় থেকে রক্ষা করে। পানি বিশুদ্ধকরণে ব্যবহূত ন্যানো ফিল্টার তেলসহ পারদের মতো ভারী ধাতু ছেঁকে ফেলতে পারে। মলিবডেনাম ডাইসালফাইড সমৃদ্ধ পাতলা পর্দার ফিল্টার সাগরের লোনা পানিকে লোনামুক্ত করতে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রসাধনীতে জিংক অক্সাইডয়ের ন্যানো পার্টিকেল যুক্ত হওয়ায় ত্বকের ক্যানসার রোধ করা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে সানস্ক্রিন ও ময়েশ্চারাইজার তৈরির কাজে ব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থ তৈরির ক্ষেত্রে এবং এন্টি-এজিং ক্রিম তৈরিতেও ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহূত হয়।
বস্ত্রশিল্পে কাপড়ের ওজন ও ঘনত্ব ঠিক রাখার জন্য ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহূত হচ্ছে। ন্যানো সেনসর খাদ্যের রাসায়নিক ও গ্যাসের উপস্থিতি, খাদ্যের পচন শনাক্তকরণে ব্যবহূত হয়। খাদ্য প্যাকেজিংয়ে ন্যানো ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহারের ফলে খাদ্যের মান ভালো থাকে এবং বাইরের আলট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশন থেকে খাদ্যকে রক্ষা করে। জ্বালানির চাহিদা মেটাতে ন্যানো প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা হচ্ছে। কম খরচে জ্বালানি উত্পাদন, জ্বালানি উেসর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফুয়েল তৈরির কাজে যেমন—হাইড্রোজেন আয়ন থেকে ফুয়েল, সৌর বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য সৌরকোষ তৈরির কাজে এবং বিভিন্ন ব্যাটারির জন্য ফুয়েল সেল তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহূত হচ্ছে। জ্বালানি কোষ বা ফটোভোল্টাইক কোষ তৈরি করা বা ভারী ধাতব, সায়ানাইড এবং পরিবেশের ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য পদার্থ অপসারণের জন্য ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার কার্যকর ফল বয়ে আনবে। উচ্চতর শক্তি, হালকা ওজন, বর্ধিত তড়িত্ পরিবাহিতা এবং রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপের মতো বৃহত্ আকারের সমতুল্যের তুলনায় উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলোর সুবিধা নিতে বিজ্ঞানীরা ন্যানো স্কেলে উপকরণ তৈরিতে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র রোবট তৈরির গবেষণা চলছে; যা প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহার এবং যার সাহায্যে মানবদেহের অভ্যন্তরে অস্ত্রোপচার সম্ভব হবে।
সোলার প্যানেলে স্বল্প খরচে এবং আরো কার্যকর উপায়ে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূর্যের আলোকে বিদ্যুত্শক্তিতে রূপান্তর করা যাবে। জ্বালানির চাহিদা মেটাতে ন্যানো টেকনোলজি প্রয়োগের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। মোবাইল ফোন, আই প্যাড বা কম্পিউটারে ন্যানো সোলার সেল ব্যবহার করা গেলে এগুলোর আকৃতি অনেক ছোট হয়ে যাবে। ম্যাগনেটিক র্যাম ব্যবহারের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই কম্পিউটার বুট করা যায়; যা করতে ইতিপূর্বে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত। কার্বন ন্যানো টিউব ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক তারের রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে ইলেকট্রিক গ্রিডে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে করে পাওয়ার লস কম হচ্ছে। খুবই সূক্ষ্ম ক্যামেরা দিয়ে ছবি উঠবে, যা হয়তো করো চোখে পড়বে না। নাসার বিজ্ঞানীগণ এমন এক সেনসর ডেভেলপ করেছেন, যা ফায়ার ফাইটারগণ আগুনের তীব্রতা সেলফোন দিয়ে মনিটর করতে পারবেন। বিল্ডিং, ব্রিজ, টানেলের কাঠামোগত বিশুদ্ধতা ও কর্মক্ষমতা মনিটরে তথা ধারাবাহিক রক্ষণাবেক্ষণে ন্যনোস্কেল সেনসর ও ডিভাইস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বর্তমানে অত্যাধুনিক যানবাহনসমূহে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহূত হচ্ছে। যেমন—লেন পজিশন সেনসর দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক জ্যাম এড়ানোর জন্য ব্যবহূত হচ্ছে। চালকদের গাড়ি চালনা আরো সহজতর করার জন্য বিভিন্ন ডিভাইস ও সেনসর ব্যবহূত হচ্ছে। গাড়ির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে থার্মোইলেকট্রিক ম্যাটারিয়াল ও গাড়ির জ্বালানিতে এডিটিভ হিসেবে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহূত হচ্ছে। পলিমার ন্যানো কম্পোজিট ব্যবহারে কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের ওজন ক্রমশ হালকা হচ্ছে। নাসার গবেষণা অনুযায়ী, এটি বাণিজ্যিক বিমানের ২০ শতাংশ ওজন কমায় এবং ১৫ শতাংশ ওজন সাশ্রয় করে। ইলেকট্রনিক সার্কিটে সুইচ হিসেবে ব্যবহূত ট্রানজিস্টর ন্যানো টেকনোলজির বদৌলতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। গত শতাব্দীতেই এর আকৃতি ছিল ১৩০ থেকে ২৫০ ন্যানোমিটার। ২০১৪ সালে ইনটেল তৈরি করল ১৪ ন্যানোমিটার, ২০১৫ সালে আইবিএম তৈরি করল ৭ ন্যানোমিটার। আর লরেন্স বারক্লে ন্যাশনাল ল্যাব তৈরি করল ১ ন্যানোমিটার। ফলে একটি কম্পিউটারের মেমোরি ক্ষুদ্র চিপের ওপর স্টোর করা সম্ভব হচ্ছে।
ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহারে উন্নতমানের ব্যাটারি তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো খুব দ্রুত চার্জ হয়, ওজনে হালকা, কার্যকর এবং দীর্ঘ সময় চার্জ ধরে রাখতে পারে। কম ওজনের স্পেসক্র্যাফট ডিজাইনের জন্য ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে। এমনকি স্পেস লিফটের জন্য ক্যাবলগুলো ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজাইন করা হচ্ছে। ন্যানো টেকনোলজি আমাদের জীবনকে আরো সহজ করে দিয়েছে। যেমন—মেডিসিন, কম্পিউটারিং, যোগাযোগ, মহাকাশযাত্রার অগ্রগতি, আশ্চর্যজনক ডিজাইন তৈরি করাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ন্যানো টেকনোলজির কল্যাণে উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়