জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসনের উপায় হিসেবে ১৯৬২ সাল থেকে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে শুধু পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তারা এই ধারা অব্যাহত রেখেছে। এরপর ইউরোপে এই ধারণার প্রসার ঘটতে শুরু করে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আরো ব্যাপকতা লাভ করে ৭০ দশকে জ্বালানিসংকটের সময়। ১৯৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডে গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। নব্বইয়ের দশকে এই উদ্যোগের আরো প্রসার ঘটে। যেমন বিশ্বব্যাপী ‘কার ফ্রি সিটি নেটওয়ার্ক’ গড়ে ওঠে। এরপর ১৯৯৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সে জাতীয়ভাবে ৩৪টি শহরে গাড়িমুক্ত দিবস পালিত হয়। পরের বছর ফ্রান্স ও ইটালির ৯০টি শহরে দিবসটি পালনে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ২০০১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্বের ৩৩টি দেশের প্রায় ১ হাজার শহরে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। এখন প্রতি বছর প্রায় ৪ হাজার শহরে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
শহরে যানজট নিরসনে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যার মধ্যে রয়েছে ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কালশী ফ্লাইওভার উদ্বোধন, ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল। এর পরও প্রতিনিয়ত সড়কে যান্ত্রিক যানের আধিক্যের কারণে যানজট যেমন বাড়ছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালিত হয়। ২০১৬ সাল থেকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মূলত এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগত গাড়ি পরিহার করে, অর্থাত্ যান্ত্রিক যান ব্যবহার না করে অযান্ত্রিক যান যেমন—রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাতায়াত করতে সচেতন করা হয়। এর ফলে শুধু যানজট নিরসন নয়, জ্বালানি তেলের সাশ্রয়, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও বাতাসে কার্বনের মাত্রাও কমিয়ে আনার চেষ্টা চলে। অন্যদিকে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
দিবসটি পালনের আরো একটি মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শহরকে দূষণমুক্ত রাখা এবং বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিবহনের উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য জনমত গড়ে তোলার আন্দোলন আরো বেগবান হয়। নগর যাতায়াত পরিকল্পনায় পরিবেশ একটি বড় বিষয়, যা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, সেটি মনে করিয়ে দিচ্ছে বর্তমান শহরের অসহনীয় যানজট। যান্ত্রিক বাহনকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে যে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব, তা প্রমাণের জন্যই এই ব্যবস্থা। এজন্যই সারা বিশ্বে এখন পরিবেশবান্ধব নগর যাতায়াতকে প্রধান্য দিয়ে হাঁটা ও সাইকেলকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ৮০ শতাংশ যাতায়াত পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে, যার অর্ধেক যাতায়াত আবার দুই কিরোমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। এই স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতের জন্য সাইকেলে ও হেঁটে নিরাপদে চলাচলের পরিবেশ তৈরি করা এবং অধিক দূরত্বের জন্য গণপরিবহন নিশ্চিত করা গেলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমানে যানজটের কারণে প্রতিদিন লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। জ্বালানির অপচয় হচ্ছে, বাড়ছে দূষণ। এজন্য বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে।
বর্তমানে ঢাকায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে। প্রতিদিন যোগ হচ্ছে প্রায় ৪০টি নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি। এছাড়া মোটরসাইকেলের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, এটিও দুর্ঘটনা ও দূষণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তাই উন্নত গণপরিবহনব্যবস্থার বিকল্প নেই। রিভাইজ স্ট্র্যাটেজিক ট্রানসপোর্ট প্ল্যানের (২০১৫-২০৩৫) পথচারীদের অগ্রাধিকার প্রদান, সাইকেলে চলাচলের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি ও গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এর পরেও শহরে পথচারীদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সড়কে চলাচলে তারা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। ইতিমধ্যে মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজেশন, প্রয়োজনীয় সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, মানসম্মত ফুটপাত তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের যে কাজ চলমান রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করেও শহরের যানজট কমানো যাবে না, যদি আমরা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি। বাসরুট ফ্র্যাঞ্চাইজ, প্রশস্ত ফুটপাত ও আধুনিক গণপরিবহনের মাধ্যমে আমাদের যাতায়াতব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগরে রাস্তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী গাড়ির সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। যানজট হ্রাসে গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা প্রয়োজন।
আমাদের পথচারী ও সাইকেলবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের ২০৩০ সাল নাগাদ সবার জন্য প্রবেশগম্য, নিরাপদ, সুলভ ও টেকসই পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং গণপরিবহনব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এ লক্ষ্যে আমাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হবে। এগুলো সম্পন্ন হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উদ্যাপনের মধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা গেলে স্বল্প দূরত্বে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে মানুষকে নিরুত্সাহিত করা সম্ভব। এর ফলে যানজট যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, ঠিক তেমনি পরিবেশের দূষণও কমে আসবে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী