বলা হইয়া থাকে, উন্নয়নশীল বিশ্বে রাজনীতি করা কঠিন। বিশেষ করিয়া, নির্বাচনের সময় দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ঘোলা হইয়া উঠিবার ফলে সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল-কঠিন আকার ধারণ করে। নির্বাচন যত ঘনাইয়া আসে, আশঙ্কা-আতঙ্ক-সংঘাত ঘিরিয়া ধরে চতুর্দিক হইতে। ইহার কারণ হিসাবে একটি শব্দই উচ্চারণ করা যথেষ্ট—‘অনিশ্চয়তা’। কি রাজনীতি বা নির্বাচনের মাঠ, কি অর্থনীতি কিংবা ব্যবসায়-বাণিজ্য—ভোটের সময় আসিলে সকল ক্ষেত্রেই বিরাজ করে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা। এই দাবির সঙ্গে কি দ্বিমত করা যাইবে? আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দাঁড়াইয়া দেশের সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কী বলিতেছে? স্বীকার না করিবার উপায় নাই, দেশে নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই নিকটবর্তী হইতেছে, জনমনে দানা বাঁধিতেছে একধরনের ‘শঙ্কা’। জনগণকে গ্রাস করিতেছে ভয়, ভীতিকর পরিবেশ। প্রশ্ন উঠিতে পারে, কীসের ভয় এবং সংঘর্ষ ও সংঘাতই-বা বাধিবে কী কারণে ও কাহাদের মধ্যে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর সহজ নহে। তবে না বুঝিতে পারিবার কথা নহে, বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পৃথিবী যখন থমকাইয়া দাঁড়াইয়াছে, তখন উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলির অবস্থা হইয়া পড়িয়াছে সবচেয়ে সঙ্গিন। ফলস্বরূপ, এই সকল দেশে যেই সকল সরকার ক্ষমতার চেয়ারে রহিয়াছেন, তাহারা নির্বাচন লইয়া পার করিতেছেন নির্ঘুম রাত্রি!
বিশ্বব্যাপী যেই সংকট বা সংকটাবস্থা চলিতেছে, অন্যান্য দেশের ন্যায় তাহার অভিঘাত বিক্ষত করিতেছে এই জনপদকেও। বাস্তব সত্য হইল, সরকার মুখে যাহাই বলুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে দেশে কী ঘটিতেছে, তাহা অজানা থাকিবার কথা নহে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নির্বাচন মানেই যেই হেতু ‘অনিশ্চিত যাত্রা’, সুতরাং এইখানে অনুকূল ও শান্ত পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন করিবার চিন্তা করাটা দুরূহই বটে! ভোটের সময় উন্নয়নশীল বিশ্বের আসল চিত্র ইহাই। অর্থাত্, বৈশ্বিক সংকটকালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ হিসাবে বাংলা ভূখণ্ডে অনুষ্ঠিতব্য এই বারের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়াটা সহজ হইবে না! উন্নয়নশীল বিশ্বে নির্বাচনের বেশ পূর্ব হইতেই ব্যবসায়-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির গতি শ্লথ হইয়া উঠে। তাহা ছাড়া থাকে বৈদেশিক হিসাব-নিকাশ ও দরকষাকষি। নিশ্চিতভাবে এই সকলের প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে!
দেখার বিষয়, নির্বাচন আসিলেই দেশে ‘আশঙ্কা’ কিংবা ‘অনিশ্চয়তা’ শব্দগুলি অধিক উচ্চারতি হয় কেন? কেনই-বা সংঘাত-সংঘর্ষের অবতারণা ঘটিবার শঙ্কার কথা উঠে? প্রকৃতপক্ষে এই উন্নয়নশীল দেশে যাহারা রাজনীতি করেন, তাহাদের অধিকাংশের কোনো ‘ক্লাস’ নাই। নাই কোনো শিক্ষা। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা-পরিপক্বতার অনুপস্থিতও চোখে পড়িবার মতো। অনেকেই রাজনৈতিক দলগুলিতে ঢুকিয়া পড়ে শেলটার লাভের আশায়। যাহারা অসত্ উপায়ে রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হইয়া উঠে, রাজনীতিকে ‘ঢাল’ হিসাবে ব্যবহার করিবার চিন্তা হইতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচনে অবতীর্ণ হইতে তত্পর হইয়া উঠে তাহারা। এবং তাহাদের নির্বাচনের মাঠ দাপাইয়া বেড়াইবার কারণেই জনমনে নেতিবাচক চিন্তা ঢুকিয়া আতঙ্ক ছড়াইয়া পড়ে। একদিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনি অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে মাসল পাওয়ারের অতি দৌরাত্ম্য—সকল কিছু মিলাইয়া নির্বাচনি আবহ নেতিবাচক হইয়া পড়ে। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি সেক্টরে নামিয়া আসে একধরনের স্থবিরতা। বিশেষ করিয়া প্রাইভেট সেক্টর পড়িয়া যায় মারাত্মক ধন্ধে, যাহার ফলে ব্যবসাদারেরা অনেক ক্ষেত্রে গুটাইয়া লইতে বাধ্য হন বাণিজ্যপরিসর।
জনমনে এই যেই শঙ্কা-ভয়, ইহার ফলে কী ঘটিতে পারে? মাইকেল প্রিচার্ডের কথা এই ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। প্রিচার্ড বলিয়াছেন, ‘শঙ্কা বা ভীতি সেই ঘুপচির অন্ধকার কক্ষে আপনাকে সেইখানে লইয়া যাইতে পারে, যেইখানে একের পর এক কেবলই অজানা ও অচেনা ভয় পাখা গজাইয়া আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া ধরিবে।’ অর্থাত্, নির্বাচনকে সামনে রাখিয়া জনমনে ভীতির সঞ্চার শুভ বার্তা নহে। দেশ ও দেশের মানুষ কিংবা অর্থনীতি—কোনোটির জন্যই ইহা সুখকর নহে।