রোববার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

চিরকালীন শত্রু বা মিত্র বলিয়া কিছু নাই

আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৩০

চলমান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন কোরামে ভাগ হইয়া গিয়াছে। একসময় শক্তিশালী প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের নিরাপত্তার নামে জোট বাঁধিল। ইহার পর তাহারা জোটের বিরুদ্ধে জোট বাঁধিতে শুরু করিল। আপাতদৃষ্টিতে একই জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ একে অপরকে মিত্র দেশ হিসাবে বিবেচনা করিয়া থাকে। এই হেতু জোটভুক্ত রাষ্ট্রের প্রতি তাহাদের বৈদেশিক নীতি থাকে কিঞ্চিত মোলায়েম এবং নমনীয়। প্রতিপক্ষ জোটভুক্ত রাষ্ট্রের প্রতি তাহাদের বৈদেশিক নীতি আবার তুলনামূলক কম নমনীয়, কখনো-সখনো যথেষ্ট কঠোর। মিত্রকে ছাড় দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু মিত্রের বাহিরে অন্যদের প্রতি কঠোরতা থাকে প্রবল। এইখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলিয়া থাকেন—মিত্র কি চিরকাল বন্ধু বলিয়া বিবেচ্য হয়? কিংবা শত্রু কি সর্বদা পরিত্যাজ্য? সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনের ভাষ্যে—রাষ্ট্রের কোনো শাশ্বত মিত্র নাই, নাই চিরস্থায়ী কোনো শত্রুও। রাষ্ট্রের স্বার্থই হইল শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। রাষ্ট্রের সেই স্বার্থ অনুযায়ী শত্রু-মিত্র নির্ধারণ ও প্রয়োজনে পরিবর্তিতও হয়।

স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হইবে তাহা এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থের উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কারণে মিত্র হইয়া যায় শত্রু, আবার এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কারণেই শত্রুতা পরিণত হয় মিত্রতায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুই পরাশক্তি ফ্রান্স এবং জার্মানির দ্বৈরথ একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়া শূন্যে মিলিয়া গিয়াছে। জাতীয় স্বার্থে তাহারা ইহার সহিত জোট বাঁধিয়াছে। আরব ও ইসরাইলের মধ্যে অর্ধশত বছরের অধিক সময় ধরিয়া বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তেজনা এখন ক্রমশ বন্ধুত্বের রূপ ধারণ করিতে যাইতেছে। আমেরিকা এবং ইরানের সুসম্পর্ক ১৯৭০ দশকের শেষে ক্রমশ খারাপ হইতে হইতে এই মুহূর্তে সম্পর্ক সাপে নেউলে হইয়া উঠিয়াছে। বর্তমান সময়ের দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তি আমেরিকা এবং চীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির মাত্র পাঁচ বছর পর কোরিয়া যুদ্ধের জের ধরিয়া আমেরিকা-চীন সম্পর্কের অবনতি ঘটিতে শুরু করে। সেই সম্পর্ক এই মুহূর্তে কেমন রূপ ধারণ করিয়াছে—তাহা বলিবার অবকাশ রাখে না।

এই যে একটি রাষ্ট্রের সহিত অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক সময়ে-সময়ে তিন শত ষাট ডিগ্রিতে উলটাইয়া যায়—ইহার পিছনে কী কারণ থাকিতে পারে? ইহার একমাত্র উত্তর হইল রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির রূপ বদলাইতে এই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সবচাইতে বড় ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রসমূহ যেই সকল নেতার দ্বারা শাসিত হইয়া থাকে, তাহাদের অনেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির রূপরেখা পরিবর্তনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নিজেদের মতো ব্যবহার করিবার চেষ্টা করেন। এডলফ হিটলার জার্মানির জাতীয় স্বার্থের নামে তাহার সম্প্রসারণবাদী নীতি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করিয়া প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করিয়াছিলেন—যাহার প্রতিফলন ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্ট্যালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় স্বার্থের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বন্দি এবং হত্যা করেন।

একটি রাষ্ট্রের প্রধান উপকরণ হইল তাহার জনগণ। রাষ্ট্রের সমস্ত কার্যক্রম তার জনগণকে কেন্দ্র করিয়া হইয়া থাকে। অর্থাৎ, জনগণের স্বার্থই রাষ্ট্রের স্বার্থ। যুগে যুগে নূতন নূতন প্রজন্মের নেতা ও রাষ্ট্রনায়করা আসিয়া থাকেন। ভূরাজনৈতিক মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটে যুগে যুগে। সেই অনুযায়ী পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংস্করণ ঘটে রাষ্ট্রীয় শত্রু-মিত্রের অবস্থানে। ইহাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা। সুতরাং জনগণের স্বার্থের দর্পণে চিরকালীন শত্রু বা মিত্র বলিয়া কিছু নাই। ইহার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশাবাদ ব্যক্ত করিতে পারি—আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চলমান উত্তেজনা এবং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহের অবসান ঘটুক। সর্বস্তরের মানুষ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেতন হইয়া উঠুক।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন