১৯৮৪ সালের কথা। তখন আমি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করি। সেই সময় আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ইয়র্কশায়ারে রাখা প্রথম রেলওয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন। বস্তুত, রেল ইঞ্জিনের আবিষ্কারক ছিলেন জর্জ স্টিভেনসন। আর বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কারক জেমস ওয়ার্ট। বিশ্বে প্রথম আন্তঃনগর রেলওয়ে লিভারপুল টু ম্যানচেস্টার (১৮৩০)। সেই রেলওয়েতে একবার বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। এদিকে এই রেলওয়ে সংক্রান্ত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপকথা, ইত্যাদি সাহিত্য অঙ্গনে কত জায়গা জুড়ে আছে! অন্য কোনো পরিবহন তেমনটা নয়।
আসলে রেল পরিবহনের ধ্যান-ধারণা ও কার্যক্রম যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে গ্রিসে শুরু হয়। এই সূত্র ধরে সেখানে ৬ কিলোমিটার থেকে সাড়ে ৮ কিলোমিটার রেলপথের প্রমাণ মেলে। অবশ্য, সেখানে মানব ও পশুচালিত চাকাযুক্ত রেলযান ব্যবহার করা হতো। আর রেলপথে চুনাপাথরের খাঁজ ব্যবহার করা হতো। পরে রোমান কর্তৃক শাসিত মিশরে এর ব্যবহারের কথা শোনা যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, রেলপথ বলতে সমান্তরালভাবে পাতা ইস্পাতের মোটা পাত দিয়ে তৈরি পথের (রেল) ওপর দিয়ে বিশেষ ধাতব চাকাযুক্ত গাড়ি (রেলগাড়ি) চালনার মাধ্যমে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহনের ডিভাইস বা উপায়কে বোঝায়। আর সড়ক পরিবহনে যানবাহনগুলো প্রস্তুতকৃত সমতল পৃষ্ঠতলের ওপরে চলাচল করে। এদিকে রেলগাড়িগুলো যে রেলপথের ওপর দিয়ে চলে, সেই রেলপথ দ্বারা নির্দিষ্ট দিকে চলাচল করে। উল্লেখ্য, রেলপথে ইস্পাতের তৈরি সমান্তরাল রেলগুলো ধরে রাখার জন্য কাঠের বাঁধুনি বা স্লিপার ব্যবহার করা হয়, আর এগুলো নুড়িপাথরের পরিস্তরণ (ব্যালাস্ট) দিয়ে তৈরি ভিত্তির ওপর স্থাপিত। তবে কিছু কিছু রেলপথে রেলগুলোকে কংক্রিটের ভিত্তির ওপরেও বসানো হয়ে থাকে।
রেল পরিবহনব্যবস্থায় ব্যবহূত রেলযানগুলো সাধারণত সড়কযান অপেক্ষা কম ঘর্ষণজনিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তাই যাত্রীবাহী রেলগাড়ি ও মালবাহী রেলগাড়িগুলো একটির পর একটি লাগিয়ে লম্বা রেলগাড়ি বা ট্রেন বানানো সম্ভব হয় এবং রেলগাড়িগুলো টানার জন্য বিশেষ ইঞ্জিনগাড়ি (লোকোমোটিভ) থাকে; যেগুলো সাধারণত ডিজেল নামক জ্বালানি তেল পুড়িয়ে অথবা বিদ্যুতায়ন ব্যবস্থা থেকে বিদ্যুত্শক্তি আহরণ করে শক্তির চাহিদা পূরণ করে। অবশ্য অতীতে এক্ষেত্রে পাথুরে কয়লা ব্যবহার করা হতো। আর বেশির ভাগ রেলপথের সঙ্গে রেলসংকেতের ব্যবস্থাও বিদ্যমান থাকে। পরিবহনের অন্যান্য প্রপঞ্চের তুলনায় রেল পরিবহন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
জার্মানিতে ১৬শ শতকের মাঝামাঝি ঘোড়ায় চালিত রেলগাড়ির প্রচলন ছিল। অবশ্য যুক্তরাজ্যে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের উদ্ভাবনের পরে ১৯শ শতকের শুরুতে আধুনিক রেল পরিবহনের পথ চলা শুরু হয় এবং আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সত্যি কথা বলতে, সেই হিসাবে যুক্তরাজ্যের রেলব্যবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন রেলব্যবস্থা। ১৮২৫ সালে স্টকটন অ্যান্ড ডার্লিংটন রেলপথের ওপর দিয়ে প্রথম বারের মতো একটি সরকারি রেলপথে যাত্রীদের পরিবহন করা হয়। এর বাষ্পচালিত ইঞ্জিনগাড়িটির নাম ছিল লোকোমোশন নম্বর ১ এবং এর নির্মাতা ছিলেন স্বয়ং জর্জ স্টিভেনসন। যেভাবেই বলি না কেন, বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়ি ছিল শিল্পবিপ্লবের এক অন্যতম নিয়ামক উপাদান। উল্লেখ্য, নৌপথে পাঠনোর চেয়ে রেলপথে খরচ কম হতো এবং মালপত্রও কম খোয়া যেত। কেননা, নৌপথে মাঝে মাঝে জাহাজডুবির আশঙ্কা থাকত। আর রেলপথের দ্রুততার কারণে পণ্যসমূহের দাম শহরভেদে মোটামুটি একই থাকে বিধায় একই ধরনের বাজার সৃষ্টির পথ সুগম হতো। আর যুক্তরাজ্যে গ্রিনিচ মান সময়কে আদর্শ ধরে প্রস্তুতকৃত রেলগাড়ির সময় তালিকাগুলো দেশব্যাপী সময়ের প্রমিতকরণ ঘটায়। মূলত যুক্তরাজ্যে রেল পরিবহনের উদ্ভাবন ও বিকাশ ছিল ১৯শ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলোর একটি। আর ১৮৬৩ সালে লন্ডনে বিশ্বের সর্বপ্রথম পাতালরেল (মেট্রোপলিটন রেলওয়ে) জনসাধারণের জন্য চালু করা হয়।
সময়ের পরিক্রমায় দিনের ওপর দিন ভর করে এগিয়ে যেতে থাকে। এই সূত্র ধরে ১৮৮০ সালের দিকে বিদ্যুচ্চালিত রেলগাড়ির উদ্ভাবন হয়। ফলে দ্রুতগামী জনপরিবহনব্যবস্থা ও ট্রামগাড়িগুলোর বিদ্যুতায়ন ঘটে। ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে বাষ্পচালিত রেলগাড়ির পরিবর্তে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনগাড়ির ব্যবহার শুরু হয় এবং এরই সুবাদে ১৯৬০ সালে জাপানে বিদ্যুতায়িত উচ্চগতির রেলব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। বর্তমানে জাপান ছাড়াও চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে উচ্চগতিসম্পন্ন রেলব্যবস্থা অব্যাহত আছে। বর্তমানে অনেক দেশই পরিবেশগত কারণে তাদের ডিজেলচালিত ইঞ্জিন থেকে সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনে রূপান্তর করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী রেলগাড়ি ছাড়াও মনোরেল (একটিমাত্র রেললাইন) ও ম্যাগলেভ (চৌম্বকীয় উত্তোলন) ধরনের রেলব্যবস্থা সীমিত আকারে হলেও কিছু কিছু দেশে চালু হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মোটরগাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে রেল পরিবহনে ভাটা পড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সড়কপথে যানজট ও জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে রেল পরিবহন আবারও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এছাড়া নানা দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসারণ কমানোর লক্ষ্যে সেই মতে রেলব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করেছে, যা পরিবেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এর প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষের নানা প্রদেশে ছোট ছোট রেলপথ সেকশন চালু করতে থাকে। প্রথম দিকে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। পরে এটি ডাইভারসিফাইন্ড করা হয়। উল্লেখ্য, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামক কোম্পানি প্রথম সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে রেলপথ স্থাপন করে। এই সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলযুগে প্রবেশ করে। বস্তুত, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কোলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ সেকশনটিকে রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত চালু করে এবং জগতি থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত চালু হয় ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি। আর ১৮৭৪-১৮৭৯ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য সাড়া থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত নর্দার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে মিটারগেজে চালু করে। এর অব্যবহিত পরে পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর এবং পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত মিটারগেজ চালু করে। ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে আসে এবং ১৮৮৭ সালের ১ এপ্রিল তা নর্দার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত হয়।
পাকিস্তান আমলের প্রায় দুই যুগ পার করে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর এ দেশের রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে, যা উত্তরাধিকার সূত্রে পায় প্রায় ২,৮৫৮.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ এবং ৪৬৬টি স্টেশন। বাংলাদেশ রেলওয়ে হচ্ছে বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও রাষ্ট্র পরিচালিত রেল পরিবহন সংস্থা। ১৯৯০ সালে এই সংস্থা নব্য প্রতিষ্ঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এর পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোরও অংশগ্রহণ রয়েছে। যেমন—খাদ্য ও ক্যাটারিং, কিছু নির্বাচিত রুট ও ট্রেনের রেলওয়ে রিজার্ভেশন ও টিকেটিং ব্যবস্থা। তাছাড়া প্রধান রেলপথসমূহে ফাইবার অপটিক কেব্ল স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও বেসরকারি সংস্থার ওপর দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়েকে মূলত দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। একটি অংশ যমুনা নদীর পূর্ব পাশে, অপরটি পশ্চিম পাশে। এদের যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের রূপসা নদীর পূর্ব প্রান্তের ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রূপসা-বাগেরহাট ব্রডগেজ রেলপথ সেকশনটিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের তৃতীয় অংশ হিসেবেও ধরা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের রেলপথ চালু আছে :ব্রডগেজ এবং মিটারগেজ। দেশের পূর্বাঞ্চলে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের রেলপথ বিদ্যমান। অবশ্য পূর্বাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বে রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথও রয়েছে। আগে ন্যারোগেজ (২ ফুট ৬ ইঞ্চি বা ৭৪৬ মি.মি.) রেলপথ চালু থাকলেও এখন আর তা ব্যবহার হয় না।
পরিশেষে বলতে চাই, রেলওয়ে নেটওয়ার্ক যেসব দেশে আছে, তা সর্বাধনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে। বাংলাদেশের রেলব্যবস্থাকেও এই প্রযুক্তির যুগে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে রেল জনপ্রিয় হবে এবং লাভবান খাত হতে পারে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা