দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে উত্তেজনা, শঙ্কা, কৌতুহল বিরাজ করছে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের কঠোর অবস্থান, বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অনেকটাই উদ্বিগ্ন। গত শুক্রবার জাতিসংঘের সদর দপ্তরের কাছে প্রধান দুই দলের মধ্যে জুতা ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা সিলেটে বেশ আলোচিত হচ্ছে। অনেকেই লজ্জ্বিত। এদিকে প্রত্যাশিত নির্বাচন কখন কোন পদ্বতিতে হবে- তা নিয়ে সিলেটে যেমন, তেমনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সিলেটের বাসিন্দাদের নানা প্রশ্ন।
কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, দেশের বাহিরে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ভীষণ দুঃশ্চিন্তায়। ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত সিলেটের একজন বাসিন্দা বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর পর পরিবার নিয়ে দেশে আসার ইচ্চা ছিল। কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে তার যত দুশ্চিন্তা।’ বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি পরিবারে লোকজন চান- সুষ্টু নির্বাচন, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন।
এদিকে সিলেটের মোট ১৯টি আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তত সোয়াশত জনের মতো মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সিলেট আওয়ামী লীগ উন্নয়ন প্রচারণায়, বিএনপি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আন্দোলনে ব্যস্ত।
সিলেট জেলায় ৬টি, সুনামগঞ্জে ৫টি, হবিগঞ্জে ৪টি ও মৌলভীবাজারে ৪টি সংসদীয় আসন রয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বলতে গেলে নেমে পড়েছেন মাঠে। বিএনপির সম্ভাব্যরাও ‘দলীয় কর্মসূচি’ পালনের মাধ্যমে ময়দানে বেশ তৎপর।
তবে গত বৃহস্পতিবার সিলেটের সমাবেশে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘তত্বাবধয়ক সরকার ছাড়া শেখ হাসিনার অধিনে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলেছে, ‘সংবিধান অনুযায়ী যথা সময়ে নির্বাচন হবে’- এমনি কঠোর অবস্থানের পরও দুই দলের নেতারা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা আপাতদৃষ্টিতে ‘বিরোধী রাজনৈতিক’ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। তবে চিন্তিত ‘ঘরের শক্র বিভীষণ’ দের নিয়ে।
ঐক্যবব্ধ আওয়ামী লীগ গড়ার সংকল্প
দিন যতই ঘনিয়ে আসছে অনেক স্থানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভেতরকার দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা চলছে। সুনামগঞ্জে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গড়ার সংকল্প নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগারে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা আওয়ামী লীগের ৭৫ সদস্যের মধ্য প্রায় ৫৯ জন উপস্থিত ছিলেন।
পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পক্ষকাল আগেই অনুষ্ঠিত সভাটি নেতা-কর্মীদের অনেকটাই চাঙা করে তুলেছে। তবে বাহিরে থাকা দলের একটি অংশ সভায় আসেননি। তাদের অভিযোগ; তৃণমূলের অনেকেই জেলা কমিটিতে স্থান পান নাই। ঐ সভায় সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র সহসভাপতি ও সুনামগঞ্জ- ৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, বর্তমান কমিটির সহসভাপতি ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন উপস্থিত ছিলেন না।
এ প্রসঙ্গে জেলা সভাপতি নূরুল হুদা মুকুট ও সাধারণ সম্পাদক সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস রেখে আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। সকল বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করতে আমরা এবার জেলার ৫টি আসন নেত্রীকে উপহার দিতে চাই।
সবকটি আসনেই সরকারি দল, বিরোধী দলের একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের চারটি আসনেই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছে। কিন্তু সুনামগঞ্জ-৪ আসনটিতে ১৪ দলের প্রার্থী হয়ে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান মিছবাহ দুই মেয়াদে সংসদ সদসস্যের দায়িত্ব পালনকালে বেশ কাজও করছেন। কিন্তু আসনটি ফিরে পেতে চায় আওয়ামী লীগ। এ আসনে দলের একাধিক নেতা মনোয়ন চাইবেন।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনে সংসদ সদস্য পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নানের আগ্রহে বঙ্গুবন্ধু মেডিকেল কলেজসহ বহু উন্নয়ন কাজ সম্পন্নের পথে। সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায় স্থাপন, উড়াল সড়ক, সুনামগঞ্জ রেললাইন স্থাপনসহ আরও বেশ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তার দুই মেয়াদে প্রচুর কাজ হয়েছে। তবে এই আসনেও নিজ দলের ভেতর থেকে অনেকেই প্রার্থী হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেন। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আলা আমিন চৌধূরীর পক্ষে এলাকায় প্রচারণায় নেমেছেন অনেকেই। তবে সাধারণ কর্মীরা বরেন, চুড়ান্ত সীদ্ধান্ত নেবেন দলের সভা নেত্রী।
অনেকটাই নির্ভার এমএ মুমেন, শাহাবুদ্দিন, মাহবুব আলী
সিলেট-১ এ আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বর্তমান সংসদ সদস্য ও পররাস্ট্র মন্ত্রী ড. এমএ মোমেন অনেকটাই নির্ভার। হবিগঞ্জ-৪ আসনেও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর বিপরীতে দলের কেউ প্রকাশ্যে নেই এখন পর্যন্ত। মৌলভীবাজার-১ আসনের বর্তমান এমপি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনও অনেকটা নির্ভার। এ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি এবাদুর রহমানের ইন্তেকালের পর আসনটি এখন পর্যন্ত তার কথাই বলে। এক সময়ের ডাকসাইট নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ১/১১ পর বহিষ্কৃত হলে মৌলভীবাজার-২ আসনে বিগত নির্বাচনে ধানের ছড়া নিয়ে এনএম শাহীনকে হারিয়ে দেন। এখন ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার’ চেষ্টায় আছেন সুলতান মনসুর। তবে শেষ দৃশ্য এখনো বেশ দূর।
সিলেট-২ আসনে গণফোরামের মোকাব্বির হোসেন বর্তমান সংসদ সদস্য। এ আসনটিও আওয়ামী লীগ ফিরে পেতে চায় এবং এখানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই দলীয় মনোনয়নে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, দল যাকেই মনোয়ন দেবে, তার পক্ষেই সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
আওয়ামী লীগের মনোয়ন প্রত্যাশীরা সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম, আর বিএনপির মনোয়ন প্রত্যাশীরা দুর্নীতি, অর্থ পাচার, সরকারের দমন-পীড়নসহ বিশেষ করে নিরেপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রাধান্য দিয়ে মাঠে তৎপর। তবে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিই এখন মূল লক্ষ্য।
একাধিক সূত্র জানায়, সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে অন্তর দ্বন্দ্বের রেশ কাটেনি এখনো। স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে কিছু না বললেও স্বস্থিতে নেই- মন্তব্য একাধিক তৃণমূল কর্মীর। তবে নব নির্বাচিত মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, দলে কোনো বিভেদ বা দ্বন্দ্ব নেই। আমার সঙ্গে সুসর্ম্পক রয়েছে সকলের।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ বিএনপি
সিলেটে একসময় সাবেক অর্থমন্ত্রী বিএনপি নেতা এম সাইফুর রহমান ও দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর দুটি বলয় গড়ে উঠে। তবে মরহুম সাইফুর রহমান ও নিখোঁজ এম. ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতে সেই দৃশ্যপট অনেকটাই পাল্টে গেছে। দলের একটি বড় অংশে প্রভাব রয়েছে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের।
আবার কয়েকদিন আগে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ দেওয়া হয়। এ দুজনের দুটি বলয় রয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরীর কোনো বলয় নেই। তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বত্র। এক সময় কাইয়ূম ও আরিফুল দুজনই এম. সাইফুর রহমনের খুব কাছের ছিলেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কি অবস্থা দাঁড়ায় তা দেখার সময় আসেনি। তবে খন্দকার মুক্তাদির বলেন, এ সরকারের পতন নিশ্চিতের জন্য ঐক্যব্ধভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আরিফুল হক বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে কোনো পক্ষ নেই।
অন্যদিকে অন্তত এক যুগ পর সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা একসঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা কমিটির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া কোনো আন্দোলন নেই। জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবুল মনসুর মোহাম্মদ শওকত বলেন, নির্যাতিত নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম বলেন, লক্ষ্য এখন সুষ্টু নির্বাচন।