রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বাইডেন-নেতানিয়াহু বৈঠকে আসলে কী ঘটেছিল

আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৩০

উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেষ পর্যন্ত সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কের থমথমে ভাবও কাটতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। দেশ দুটির মধ্যে ‘ঐতিহাসিক সম্পর্ক’ পুনঃস্থাপনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বস্তুত, বহুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই আঞ্চলিক শক্তিকে পাশাপাশি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে আসছিল বাইডেন প্রশাসন। এরই ধারবাহিকতায় সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক নতুন করে জোড়া লাগতে শুরু করেছে ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায়।

মানতে হবে, সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা শ জটিল হবে। কারণ, দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল করার আলোচনা বরাবরই ঘুরপাক খায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়ে ইসরাইলের সম্ভাব্য ছাড়ের ব্যাপারটিও মোটাদাগে অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া আলোচনার কেন্দ্রে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং রিয়াদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সৌদির বেসামরিক পারমাণবিক কার্যক্রমে সহায়তার মতো বিষয়।

যা হোক, সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সম্ভাব্য একটি চুক্তি নিয়ে কাজ করার কথা শোনা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মুখে। গত বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পার্শ্ববৈঠকে মিলিত হয়ে এমন ঘোষণা দেন দুই নেতা। গত ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসার পর বাইডেনের সঙ্গে প্রথম বারের মতো মুখোমুখি ঐ বৈঠকে এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মধ্য দিয়ে সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো।

বলে রাখা দরকার, দীর্ঘদিন ধরে একটি সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছিল তিন দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও সৌদি আরব। সম্ভাব্য চুক্তির আওতায় ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার কথা সৌদি আরবের। তাছাড়া ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যেও স্বাক্ষর হবে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি। যদিও এই চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি এখন অবধি। মার্কিন কর্মকর্তারা একটি আঞ্চলিক বড় চুক্তির (সৌদি-ইসরাইল) সম্ভাব্য সুবিধার কথা বলেছেন মাত্র। তবে বাস্তব সত্য হচ্ছে, এই চুক্তি আলোর মুখ দেখলে তা হবে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির জন্য ‘বড় ধরনের সাফল্য’। সেক্ষেত্রে ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তা বাড়তি সুবিধা এনে দেবে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে।

বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে জো বাইডেনের বয়স নিয়ে নানা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও চলছে বিভিন্ন মহলে। সবখানে যেন একটাই কথা—‘বাইডেন বৃদ্ধ’। বাইডেনের বয়স বেড়ে গেছে—এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সবার জেনে রাখা দরকার, ‘পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে!’ বাস্তবতা হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলার গতি ধীর হওয়া কিংবা কোনো কিছু ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, বয়স বাড়ার ফলে কি কেবল নেতিবাচক দিকই পরিলক্ষিত হয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর উত্তরে বলতে হবে—‘না’। এই দাবির কারণ, বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বুদ্ধি। সুতরাং, বাইডেনকে ‘বৃদ্ধ বা অতিবৃদ্ধ’ বলে তাচ্ছিল্য করাটা সমীচীন নয় কোনোভাবেই। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

ওপরের দাবির সপক্ষে আমার হাতে গ্রহণযোগ্য যুক্তিও রয়েছে। বাইডেন-নেতানিয়াহু বৈঠক কাছ থেকে দেখেছি আমি। অনেকে হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, দুই নেতার আলোচনায় বিশেষ করে বাইডেনকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী দেখা গেছে। অথচ বৈঠকের ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্তও ইসরায়েলি সাংবাদিকসহ আমার পরিচিত বেশ কিছু সহকর্মীকে হতাশ হয়ে পড়তে দেখেছি। যা হোক, নেতানিয়াহু বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে যখন জানান, ‘এটা ছিল উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ বৈঠক’, তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, ঠিক কী ধরনের আলাপচারিতা চলেছে দুই নেতার মধ্যে। আমেরিকা ও ইসরাইলের মধ্যে ‘অটুট বন্ধন’ বজায় রাখার বিষয়ে যখন কথা বলছিলেন বাইডেন, তখন খুব ভালোমতোই বুঝতে পারা যাচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সম্পর্কের শেকড় কতটা গভীরে।

‘বিচারিক অভ্যুত্থান’ ইস্যুর কারণে অনেক ইসরায়েলির মনে আশঙ্কা ছিল, নেতানিয়াহুকে সম্ভবত পাশে বসাতে চাইবেন না বাইডেন। কিন্তু বাস্তবে যখন ভিন্ন চিত্র দেখা গেল, তখন সবাই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ‘নেতানিয়াহুর হারানোর কিছু নেই।’ সত্যি বলতে, বাইডেন যে নেতানিয়াহুকে আলিঙ্গনে বাঁধবেন, তা নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না আমার মনে। এ কারণে বাইডেন-নেতানিয়াহুর অন্তরঙ্গতা দেখে মনে মনে বলছিলাম কেবল একটাই কথা, ‘আমার ধারণাই সঠিক, আমার ধারণাই সঠিক, আমার ধারণাই সঠিক।’

যখন নেতানিয়াহুর কাঁধে হাত রাখেন বাইডেন, এটা ছিল দেখার মতো দৃশ্য! বাস্তবিক অর্থেই এটা ছিল এমন এক তাত্পর্যপূর্ণ দৃশ্য, যার মানে বুঝতে ঐ সময়ের ভিডিও ফুটেজ ডাবল স্লো-মোশনে দেখতে হবে আপনাকে। আরেকটি বিষয়, নেতানিয়াহুকে কী যেন সব বলছিলেন বাইডেন! আমার ধারণা, বাইডেন নেতানিয়াহুর কানের কাছে বিড়বিড় করছিলেন, ‘নেতানিয়াহু, আপনি কি এ ধরনের চুক্তি চান, যা ইসরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে?’ সম্ভবত নেতানিয়াহু তখন বলছিলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি তো চাই এমনটাই!’

বাস্তবতা হলো, বাইডেন-নেতানিয়াহুর মধ্যে যে ধরনের কথাবার্তাই হোক না কেন, অস্বীকার করার উপায় নেই—এ ধরনের চুক্তিকে সফল করতে হলে নেতানিয়াহুকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সৌদি নেতা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না ইহুদি রাষ্ট্রের এই নেতার।

সবার জানা, যুক্তরাষ্ট্রের ‘দীর্ঘদিনের অন্যতম সহচর’ ইসরাইল। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সব সময়ই ভিন্নভাবে দেখে থাকে দেশটি। সবকিছু ছাপিয়ে বড় বিষয় হলো, সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে ঢুকে পড়েছে ‘বিশেষ সমীকরণ!’ এসব বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতেই বাইডেন সৌদি-ইসরাইল সম্পর্কের বরফ গলানোর পথে পা বাড়ানোর সাহস করে থাকতে পারেন।

বাইডেন দ্ব্যর্থহীন চিত্তে বলেছেন, ‘ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা বন্ধু।’ বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাইডেনের এ ধরনের স্পষ্ট উচ্চারণ এবং এর পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যদি সত্যি সত্যি সৌদি-ইসরাইলকে পরস্পরের কাঁধে হাত রাখতে দেখা যায়, তাহলে বাইডেনের দূরদর্শিতাকে ‘অতিপ্রশংসায় না ভাসিয়ে উপায় থাকবে না।’ তেমনটি ঘটলে অবাক হব না মোটেই! সুতরাং, বাইডেনের বয়স নিয়ে কথা না বলাটাই বিচক্ষণতা হবে।

আসন্ন ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনকে বেছে নেওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে কি না, কিংবা নিজ দল (ডেমোক্রেটিক পার্টি) থেকে তিনি মনোনয়ন পাবেন কি না—এসব নিয়ে বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে আমি শুধু এতটুকু বলতে চাই, কূটনীতিতে বয়স ও অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সেটা আবারও প্রমাণ করলেন বাইডেন।

লেখক :আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। তিন বারের পুলিত্জার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক-কলামিস্ট। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত ‘ফ্রম বৈরুত টু জেরুজালেম’ বইয়ের লেখক

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ :সুমৃত্ খান সুজন

 

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন