১৯৬৯-র ৯ জুন ইত্তেফাক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় সাংবাদিক’ শিরোনামে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (মানিক মিয়া) সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘ব্যক্তি জীবনের নির্ভীকতা ও সততা তার রচনাগুলোকে প্রভাবিত করেছে, জীবনের ন্যায় লেখার মধ্যেও তিনি কোনদিন মিথ্যার প্রশ্রয় দেননি। তার দৃষ্টি ছিল গণমুখী। জনগণের কথা বলার জন্যেই তিনি লেখনী হাতে নিয়েছিলেন। জনগণের ভাষায় তিনি কথা বলতেন। মানিক ভাই ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাদাসিধে। বিলাস ও বাহুল্যকে তিনি কোনদিন কাছে ঘেঁষতে দেননি। সামান্য আসবাবে সজ্জিত ছিল ‘ইত্তেফাক’ অফিসে তার ব্যক্তিগত বসবার ঘরখানি।’
মানিক মিয়া সম্পর্কে মোটাদাগে সব কথাই বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কলমে। এমন কথায় কোনো অতিরঞ্জন নেই; আছে দু’জনের আন্ত:সম্পর্কের গভীরতা উৎসারিত বাস্তব। মানিক মিয়া অরাজনৈতিক ব্যক্তি হলেও, বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলেন অগ্রজের মতো নমস্য একজন; মানিক মিয়ার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মানিক মিয়ার প্রথমত ও প্রধান পরিচয় সাংবাদিক হিসেবে; কিন্তু এমন পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার রাজনীতিমনস্কতা। কারণ তিনি ভাবতেন চলমান রাজনীতি নিয়ে, আর লিখতেন তার ‘মোসাফির’ কলম-নামের ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ উপসম্পাদকীয়তে, যা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। তিনি লিখতেন জনগণের কথা, জনগণের বোধগম্য ভাষায়, এবং তা শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির পক্ষে। জানা আছে, আওয়ামী লীগের অনেক সিদ্ধান্তের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিলো তার কলাম উৎসারিত পরামর্শসমূহ।
মানিক মিয়াকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চিনতে-বুঝতে তার লেখাগুলো অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করতে হবে, অনুচিন্তনে তা বুঝতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে উদ্ধৃতিযোগ্য একটি মন্তব্য মার্কিন নাট্যকার বিল এ্যাডলার-এর। তার কথা ছিলো, “Nothing describes a person better than his words’’ ---- একজন মানুষের কথা দিয়ে যতটুকু বোঝা যায়, তা আর কিছুতে নয়। কথা তো দু’ধরণের--মুখনি:সৃত আর কলম নি:সৃত; অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে কাউকে কাউকে শুধু তার বলা কথা থেকেই চিনতে হয়; কারণ তার লেখা হয় নেই, বা দুষ্প্রাপ্য। মানিক মিয়া বলেছেন, লিখেছেনও; তার লেখা বই আছে, ভাষণগুলোও গ্রন্থিত করে ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ মানিক মিয়াকে চেনা-বোঝার মতো উপকরণ সহজলভ্য। তার বাংলা ও ইংরেজি লেখা আছে। দুই ভাষায় তার পারঙ্গমতা স্বীকৃত।
জীবনালেখ্য ও মানসলোক
মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১-তে, বর্তমান পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থানায়। তার প্রয়ান ১৯৬৯-এ ইসলামাবাদ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। মাত্র আটান্ন বছর আয়ু ছিলো তার। আজকের পৃথিবীতে যারা স্মরণীয়-বরণীয়, তারা কেউই দীর্ঘজীবী হতে পারেননি; তারা জীবনের দৈর্ঘ থেকে বঞ্চিত হলেও, কর্মে বা খ্যাতিতে ছিলেন অপরিমেয় সমৃদ্ধ। এমন মানুষ সম্পর্কে ইংরেজিতে প্রবচন আছে Larger than life—জীবনের চেয়ে বড়। সংক্ষিপ্ত জীবনে তারা জীবন ও জগতকে তাদের কর্মগুণে যেভাবে সমৃদ্ধ করেন, তাই তাদেরকে করে চিরস্মরণীয় এবং বরণীয়। মানিক মিয়া এমন-ই একজন কৃতিধন্য মানুষ ছিলেন। তিনি আরও আয়ু পেলে আমরা হয়তো বা সমুদ্ধতর হতাম; কিন্ত সমৃদ্ধ তো কম হইনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি, যার সৃষ্টিতে তার অবদান স্বীকৃত সত্য। তিনি স্বাধীনতার পর বেঁচে থাকলে দেশটি তার বিবেক উৎসারিত সাহসী দিকনির্দেশনা পেতো; স্বাধীন দেশে নবযাত্রা করা সাংবাদিকতা আলোর দিশা পেতো। বিবেকী সাহসের উচ্চারণ এখন দুর্লভ। কাজেই মানিক মিয়ার অবর্তমানে দেশটি বেশ বঞ্চিত ও দরিদ্র।
মানিক মিয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বরিশাল বি.এম. কলেজের স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু বক্তৃতা ও লেখায় যে মানিক মিয়া উদ্ভাসিত, তাতে মনে হয়, তিনি আপন মেধায় স্বশিক্ষায় অনেকদূর এগিয়েছিলেন। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানিক মিয়ার জ্ঞান-অন্বেষার পাটাতন তৈরি করেছিলো।
পেশাগত জীবন শুরু হয় পিরোজপুর মহকুমা কর্মকর্তার সহকারি হিসেবে; কর্মদক্ষতার গুণে সহজেই হয়ে যান বরিশাল শহরের জনসংযোগ কর্মকর্তা। অর্থাৎ তার জীবন শুরু হয় সরকারি চাকুরে হিসেবে; কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তার পেশাগত জীবনের পর্বান্তর হয় সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে। মানিক মিয়া ১৯৪৩-এ কোলকাতা গিয়ে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ কার্যালয়ে সেক্রেটারি হিসেবে নতুন পেশাগত জীবন শুরু করেন। তবে সেখানেও বেশিদিন থাকেননি। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি ইত্তেহাদ পত্রিকার পরিচালনা পর্ষদের সেক্রেটারি হলেন। উল্লেখ্য, পত্রিকাটি ছিলো সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সোহরাওয়ার্দী মানুষ চিনতে ভুল করেননি। মানিক মিয়া আর বঙ্গবন্ধু দু’জনই ছিলেন তার স্নেহ ও সৌজন্যধন্য। মানিক মিয়া পরবর্তী জীবনে হয়েছিলেন সাংবাদিকুল শিরোমণি, আর বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। মানিক মিয়া তার সাংবাদিকের মনন ও কলম দিয়ে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে বিবেকী সাহসের কথা উচ্চারণ করেছেন আর অনলবর্ষী সব লেখা লিখেছেন; অন্যদিকে সত্যলগ্ন সাহসী বঙ্গবন্ধু কালে কালে হয়েছেন রাজনীতির হিমাদ্রিসম ব্যক্তিত্ব --- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। সোহরাওয়ার্দী তার স্নেহধন্য এ দু’জনকে গণতন্ত্রের সবক দিয়েছিলেন। মানিক মিয়া কলম আর মুখ দিয়ে গুরু-বিদ্যা চর্চা করেছেন আমৃত্যু; বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের চর্চা করেই বাংলাদেশ হাসিল করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী যথার্থই একজন গুরু নেতা ছিলেন। নেতার অন্যতম বড় কাজ আগামীর নেতা তৈরি করা; সোহরাওয়ার্দী তা করেছিলেন। মানিক মিয়া হয়েছিলেন সাংবাদিকতার নেতা; আর বঙ্গবন্ধু রাজনীতির নেতা। উপরন্তু দু’জনই গুরুবিদ্যা অনুযায়ী আগামীর অনুসারী তৈরি করেছিলেন।
মানিক মিয়া ১৯৪৮-এ ঢাকা ফেরেন; এবং তারপরেই তার সাংবাদিকতার স্ফুরণ হতে শুরু করে। ১৯৫১-তে তিনি মাওলানা ভাসানীর কাছ থেকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক -এর সম্পাদকের দায়িত্ব বুঝে নেন। ১৯৫২ তে (২-১২ অক্টোবর) তিনি পিকিং (এখন বেইজিং) এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় শান্তি সম্মেলনে যান। বিশ্ব পরিসরে মানিক মিয়ার এই প্রথম অভিজ্ঞতা। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুও গিয়েছিলেন। ১৯৫৩-তে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক হয়ে যায় দৈনিক ইত্তেফাক। তারপর থেকে দৈনিক পত্রিকাটি জনগণের কাছাকাছি চলে যায়। সম্পাদক একটি পত্রিকার চরিত্র ও প্রকৃতি নির্ধারণ করেন, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মানিক মিয়ার ভাগ্যে কিছু সরকারি তকমা জুটেছিলো। তিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউটের পাকিস্তান শাখার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন (১৯৬৩)। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সরকারি প্রেস কোর্ট অব অনার্স-এর সেক্রেটারি এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ)-এর পরিচালক। উল্লেখ্য, দুটো প্রতিষ্ঠানই ছিলো সরকার পোষিত।
আইউব খান-এর সামরিক শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) মানিক মিয়ার ভাগ্যের চাকা বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। সোহরাওয়ার্দী-শিষ্য আর সামরিক স্বৈরাচার সমান্তরালবর্তী হওয়া সম্ভব ছিলো না। কাজেই বিবেকী মানিক মিয়ার জন্য সামরিক স্বৈরাচার ছিলো অশনিসংকেত। তিনি তিনবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৫৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। ১৯৬২ তেও তাকে কারাজীবন ভোগ করতে হয়। তবে ১৯৬৬-র ১৬ জুন তার কারাজীবন ছিলো বেশ দু:সহ। তার পত্রিকাও ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস সরকার বাজেয়াপ্ত করে; অন্যদুটো পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও সিনে-পত্রিকা সাপ্তাহিক পূর্বাণীও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর ইত্তেফাক-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯); এবং পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। মানিক মিয়া লোকান্তরিত হন ৩১ মে ১৯৬৯ (অথবা ১ জুন)। কাজেই তিনি কিছুদিন পুনরুজ্জীবিত ইত্তেফাক-এর কর্ণধার থাকতে পেরেছিলেন।
মানিক মিয়া কোনোদিন রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ছিলেন না; তবে সমাজ ও রাজনীতির সংশ্লেষ আছে, এমন ইস্যুগুলোর প্রতি তিনি মানসিক ও চেতনাগত নৈকট্য অনুভব করতেন। ভাষা আন্দোলন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর জোরালো সমর্থনপুষ্ট ছিলো। বলা হয়, ১৯৫৪-র প্রাদেশিক পরিষদের যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে প্রচার-প্রচারণায় মানিক মিয়ার ক্ষুরধার লেখনী অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিলো। উপরন্তু, জনতার ঐক্যের স্বার্থে তিনি ১৯৫৫-৫৬-তে যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। একই কারণে তিনি ১৯৫৬-তে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভায় কৃষক-শ্রমিক পার্টির অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন দান করেন। ১৯৬২ তে এনডিএফ তার সমর্থন পায়। ১৯৬৪ তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ‘কপ’ (কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ)-এর পক্ষে কাজ করেন; পরের বছর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে তিনি আইউব-এর বিরুদ্ধে সমর্থন করেন; এবং তা-ও সামরিক স্বৈরাচারের বিপরীতে গণতন্ত্র-ব্যবস্থা পুণ:প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। অবশ্য এর আগে ১৯৬৪-তে শেখ মুজিব-এর আওয়ামী লীগ পুনর্জীবনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মানিক মিয়া। কারণ তার ধারণা ছিলো যে, এতে রাজনৈতিক দলাদলিতে গণতন্ত্রের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। পরে অবশ্য এনডিএফ-এর নিষ্ক্রিয়তার কারণে তার মত পাল্টিয়েছিলেন। অর্থাৎ পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের পক্ষে মানিক মিয়া তার অবস্থান ধরে রাখলেন।
এরই মধ্যে মানিক মিয়া বাঙালির স্বার্থসংশিষ্ট তিনটি কাজ করেছিলেন। এক, ১৯৬১-তে তার দূতিয়ালিতে তার বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির দু’জন কমরেডের সঙ্গে শেখ মুজিব-এর গোপন আলোচনা হয় একাধিকবার। কমরেড দু’জন ছিলেন মণি সিংহ এবং খোকা রায়। নির্দলীয় হবার কারণে মানিক মিয়া সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন; এ কারণে তার পক্ষে এমন দূতিয়ালি সম্ভব হয়েছিলো। যাহোক, শেখ মুজিব তার বাঙালির স্বাধীনতা প্রকল্প সম্পর্কে বামদের অভিমত অবহিত হতে চেয়েছিলেন। তিনি আলোচনার শুরুতে বলেছিলেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নাই। কমরেড দু’জন তার সঙ্গে সহমত হলেও, সতর্ক করেছিলেন, স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে তখন না বলতে; কারণ, বাঙালিবিদ্বেষী আইয়ুব খান তখন ক্ষমতাসীন। শেষমেশ, সিদ্ধান্ত হয়, একটি যৌথ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলার। শেখ মুজিব অবশ্য বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবেন না।
দুই, ১৯৬২-এর বড়দিনের মধ্যরাতের পর মানিক মিয়া তার অফিসে শেখ মুজিব-এর সঙ্গে ভারতীয় উপদূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জীর দেখা করিয়ে দেন। ৬শশাঙ্ক চক্রবর্তীর হাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে লেখা একটি চিঠি শেখ মুজিব হস্তান্তর করেন। চিঠিতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া হয়; এবং তা বাঙালির মান-মর্যাদা রক্ষা করেই। ৭ এই আলোচনাকে শশাঙ্ক ব্যানার্জী বলেছেন, “a momentous turning point in the history of South Asia.” ৮ বর্তমান আলোচনায় আমরা মানিক মিয়া সম্পর্কে আগ্রহী; কাজেই শশাঙ্ক ব্যানার্জী মানিক মিয়া সম্পর্কে কী বলেছেন, তা জেনে নেয়া যাক। উল্লেখ্য, এ আলোচনার আগে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর সঙ্গে মানিক মিয়ার চেনা-পরিচয় ছিলো না, অবশ্য জানা- শোনা ছিলো। মানিক মিয়া সম্পর্কে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর কথা।
“Although personally I had never met Manik Mia before, his name was not unknown to me. I never missed reading his politically astute polemical columns in Bengali in The Daily Ittefaq extolling the virtues autonomy for East Pakistan. I could sense that he was shrewdly using the word autonomy as a camouflage, but, in reality he was building up case for liberation.”
অর্থাৎ মানিক মিয়ার কুশলী রাজনীতিকের রাজনীতি না করেও কলম-কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
তিন, মানিক মিয়া না হলে ৬ দফার ইতিহাস বদলে যেতো, বাঙালির স্বাধীনতাও অনিশ্চিত হতো। ১৯৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আইয়ুববিরোধী সব দলের সভা হবার কথা; আওয়ামী লীগও আমন্ত্রিত। শেখ মুজিব তখন বাঙালি-মুক্তির চিন্তা-কর্মে বিভোর। তাই তিনি ঠিক করলেন, লাহোরে শাহ আজিজুর রহমান যাবেন। এই কথা শুনে মানিক মিয়া শেখ মুজিবকে বললেন, “শাহ আজিজ-এর ওপর আস্থা রাখা যায় না; সে ক’দিন আগে মুসলিম লীগ করতো, আওয়ামী লীগে নতুন। তুমিই যাও; যা বলার তা একটু নোট করে নিও।” অগ্রজ মানিক মিয়ার কথা শেখ মুজিব রেখেছিলেন; তিনিই লাহোরে যান; কিন্তু ৬ দফা উপস্থাপন করতে পারেননি; করেছিলেন পরে, যা হয়েছিলো বাঙালির বাচার দাবি, তাদের মুক্তিসনদ। সুতরাং বাংলাদেশ সৃষ্টিতে মানিক মিয়ার অবদান কম নয়। মানিক মিয়ার কথায় শেখ মুজিব লাহোর না গেলে বাঙালির ইতিহাস অন্যরকম হতো।
মানিক মিয়ার মানসলোক
কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তিই তার সময়ের খ্যাতিমান ব্যক্তির প্রভাব এড়াতে পারেন না; তারা এ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মানস গঠনে সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকেন। মানিক মিয়া নিজে খ্যাতিমান ছিলেন; কিন্তু তার খ্যাতির পাটাতন নির্মাণ করে দিয়েছিলেন অন্তত তিনজন মহীরুহ ব্যক্তি: তারা হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩), মাওলানা ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬); এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)। উল্লেখ্য, প্রথম দু’জন ছিলেন তার অগ্রজ, গুরুপ্রতিম; শেষোক্ত জন অনুজপ্রতিম, যিনি মানিক মিয়াকে অগ্রজের মতোই শ্রদ্ধা করতেন। আরও উল্লেখ্য যে, মানিক মিয়া নিজেসহ এ তিনজন ইত্তেফাক-এর চারিত্র্য নির্ধারণ করেছেন। চারজনেরই অভিন্ন মানস ছিলো, গণমুখিনতা, গণতন্ত্রকামী এবং অসাম্প্রদায়িকতা। সবাই ছিলেন বিবেকী সাহসের প্রতিকৃতি।
মানিক মিয়ার মন ও মনন ছিলো সমৃদ্ধ, যা বিস্তর পাঠ ও অনুধ্যানজনিত কারণে। তার যে পাশ্চাত্যের দর্শনেও গভীর অধ্যয়ন ছিলো, তার প্রমাণ ৮ নভেম্বর ১৯৬৩-তে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রদত্ত তার ভাষণ। এ ভাষণে পাশ্চাত্য দর্শনের মর্মার্থ তুলে ধরা হয়েছে। যে মানুষ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের মর্মশাঁস আত্মস্থ করে আপন ব্যক্তিসত্তাকে গড়ে তোলেন, তিনি হন মানবপ্রেমিক; দেশ-কালের সীমাবদ্ধ অচলায়তনে তিনি আবদ্ধ থাকতে পারেন না। সে কারণে মানিক মিয়ার উপর্যুক্ত ভাষণের শিরোনাম হয়েছে, “সর্বমানবের সার্বভৌমত্ব।” তিনি মানুষের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন, মানবপ্রেম তার সহজাত। এ ভাষণটি প্রমাণ করে মানিক মিয়া ছিলেন রেনেসাঁ-মানুষ। কারণ রেনেসাঁরও মর্মবাণী ছিলো, মানবতার জয়গান। একজন অজানা রেনেসাঁ- কবির পঙক্তি ছিলো homo sum humani nihil a me alienum puto--- মানুষ আমি, মানুষ সংক্রান্ত কোনো কিছুই আমার অজানা নয়। জীবন-প্রাম্ভিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-এর প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ ছিলো, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।” মানিক মিয়া মানুষের প্রতি অবিশ্বাসের পাপ করতে চাননি আমৃত্যু।
মানিক মিয়ার নিজের কথা দিয়েই আমরা তার মানসলোকের ভেতরে উঁকি দিতে পারি। মানবপ্রেমী মানুষ রক্তারক্তির মধ্য দিয়ে জীবনের বিপন্নতা ও জীবনের ক্ষয় পছন্দ করতে পারেন না। মানিক মিয়ার জবানিতে তাই আছে, “. . হিংসা ও রক্তারক্তিতে আমি বিশ্বাস করি না। শান্তিপূর্ণ পথে আলাপ-আলোচনা ও লেন-দেনের ভিত্তিতে আমি সমস্যার সমাধান কামনা করি।” উদ্ধৃতিটিতে বিধৃত তাঁর রাজনৈতিক দর্শনও।
মানিক মিয়ার আরও নিজের কথায় আসি, “আমি একজন বিপ্লবী ত নই-ই, . .। আমার চিন্তাশক্তি ও কর্মক্ষমতা সর্বতোভাবে “ইত্তেফাকের” পিছনেই নিয়োজিত করিয়াছিলাম। . . . যে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, সেই জনগণের অভাব-অভিযোগ, সুখ-সু:খ, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করাই ছিল আমার ব্রত। . . . . কোন প্রলোভন বা স্বার্থচিন্তা দ্বারা আমি কখনও প্ররোচিত হই নাই।” বোঝা যায়, কেন তিনি গণমুখি সাংবাদিকতার জনক হিসেবে কীর্তিত। নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “. . আমি একজন সচেতন সুনাগরিক এই দাবি আমার আছে। সাংবাদিকতা আমার পেশা এবং নেশা: দেশ ও দেশবাসীর সেবা আমার সাংবাদিক জীবনের প্রধান ও একমাত্র ব্রত। একজন সমাজ সচেতন সুনাগরিক সাংবাদিক হিসাবে দেশ ও দেশবাসীর প্রতি আমার নৈতিক দায়িত্ব আছে। আপন পেশা ও ব্রতে নৈতিক দায়িত্ব পালনে মানিক মিয়ার ঐকান্তিকতা প্রশ্নাতীত ছিলো।
নিজেকে এভাবে মেলে ধরতে গিয়ে মানিক মিয়া আত্মসমীক্ষণ করতেও ভুলেননি। “আমি সর্বদাই ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে ছিলাম, এমন ধারণা আমি পোষণ করি না। ইত্তেফাকের মারফত গণ-মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব-অভিযোগ ও চিন্তাধারা প্রতিফলিত করিতে গিয়া কোথাও যদি আমি ভুল করিয়া থাকি, তাহা ছিল জ্ঞান-বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা প্রসূত।” তুলনীয় মানিক মিয়া যাঁর গুণমুদ্ধ ছিলেন সেই বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি: ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন অনুষ্ঠিত বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি তুলে দেওয়াই এখানে প্রাসঙ্গিক হবে: আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই। আমি মানুষ। আমি ভুল করতে পারি। আমি ভুল করলে সেটা শোধরাতে হবে। আমি যদি শোধরাতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। যদি আমি গোঁ ধরে বসে থাকি যে না আমি যা করেছি সেটাই ভালো, তাহলে সেটা মানুষের কাজ হলো না। ফেরেশতা হইনি যে সবকিছু ভালো হবে। এমন আত্মসমালোচক মানিক মিয়া ছিলেন একজন প্রকৃত ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
রাজনীতিমনস্ক মানুষের উপলব্ধ রাজনৈতিক দর্শন
মানিক মিয়া সক্রিয় রাজনীতি করেননি; তিনি কোনো দলের সদস্যও ছিলেন না। তার জবানিতে আছে, ইত্তেফাক সম্পাদক হবার পর তার এমন নীতি-অবস্থান প্রকট হয়। কারণ ইত্তেফাক গণমুখি সংবাদপত্র; জনগণদলীয় বিভাজন মানে না, তারা সংবাদপত্রে তাদের সংবাদ দেখতে চায়। মানিক মিয়ার আরও একটি কারণ ছিলো। মনে হয়, তিনি শুধু সম্পাদক হিসেবে নিরপেক্ষ থাকতে চাননি, তার স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব ছিলো, যা দলীয় আনুগত্যে ম্লান হয়ে যেতো। প্রসঙ্গক্রমে স্নর্তব্য, একটি ঘটনা। সুহৃদ কীয়ের হার্ডির প্ররোচনায় জর্জ অরওয়েল ইন্ডিপেডেন্ট লেবার পার্টির (প্রতিষ্ঠাতা কীয়ের হার্ডি) সদস্য হন; কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর সদস্যপদ প্রত্যাহার করেন। কারণ তাঁর স্বাধীন মতামত বিঘ্নিত হচ্ছিলো। এটা জানা কথা, লেখক হিসেবে তিনি যা হয়েছিলেন,তা সম্ভব হতো না দলীয় সদস্য থাকলে। বোধগম্য, কেন মানিক মিয়া দলীয় সদস্য হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বড় উপদেষ্টা ছিলেন; তাঁর লেখায় আওয়ামী লীগের কথাই থাকতো। উপরন্তু, মানিক মিয়ার ইত্তেফাক ছিলো আওয়ামী লীগের সুহৃদ। পাহাড়ের সৌন্দর্য দূর থেকে অবলোকন ও অনুভব করা যায়, কাছে গেলে তা সম্ভব নয়। নির্দলীয় না থাকলে, দলীয় রাজনীতির ডামাডোল ঠিকমতো কানে পড়ে না, দৃষ্টিগ্রাহ্যও হয় না।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে অরাজনীতিক (সক্রিয়তার অর্থে) মানিক মিয়া রাজনীতি বলতে কী বুঝতেন? ১৯৬৮-র ১৯ অক্টোবর, তিনি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় একটি দিকনির্দেশক ভাষণ দিয়েছিলেন১৯, যাতে আছে তাঁর রাজনীতির সংজ্ঞা। তাঁর কথায় বলি, ইতিহাসের নিয়ন্তা . . সাধারণ মানুষ। তাই সাধারণ মানুষকে পাশ কাটিয়ে যে রাজনীতি, তাকে আমি রাজনীতি বলে গণ্য করি না। . . . রাজনীতি যে দূষণীয় নয় বরং একটি পবিত্র ব্রত। দেশের এবং দেশের মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষাইএই ব্রত গ্রহণে প্রেরণার উত্স। রাজনীতিকে যারা আত্মোন্নতি বা ভাগ্যন্নোয়নের অবলম্বন বলে ভাবেন, তাদের উচিত ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করা, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া, কন্ট্রাকটরী করা, লাইসেন্স পারমিটের জন্য উমেদারি করা; রাজনীতি করা নয়।
গণকল্যাণের রাজনীতি আর ক্ষমতার রাজনীতি এক নয়। রাজনীতি সুনিশ্চিতভাবেই ক্ষমতা লাভের উপায়, কিন্তু উদ্দেশ্য নয়। যারা রাজনীতিকে উদ্দেশ্য করে তোলে তারা ক্ষমতার রাজনীতি করে; গণকল্যাণের রাজনীতি করে না।
মানিক মিয়ার রাজনীতি এখন কতটুকু আছে? মহামান্য সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জানিয়েছেন, ৮৪ শতাংশ সাংসদ এখন ব্যবসায়ী। এমন সাংসদ মনোনয়ন বাণিজ্যের কাছে কৃতজ্ঞ। রাজনীতি এখন বিত্ত ও প্রতিপত্তি অর্জনের মোহন সড়ক; একবার এই সড়ক পরিক্রমা শুরু করলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। বাস্তব অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।
মানিক মিয়া রাজনীতির নিজস্ব সংজ্ঞায়নের সমান্তরালে রাজনীতির বড় সমস্যা স্তাবকতার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রশংসা আর স্তাবকতা/ স্তুতি সমার্থক নয়। একজন নেতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ স্তাবকতা ও স্তুতি; এবং এ দুটো অভিশাপমুক্ত হতে না পারলে একজন নেতার নেতৃত্ব বিকাশ বিঘ্নিত হতে বাধ্য। এই স্তাবকতা সম্পর্কে মানিক মিয়ার কথা শোনা যাক। ইত্তেফাক পত্রিকায় ১৯৬৯-র ৬ এপ্রিল তিনি “স্তাবকতা প্রসঙ্গে” শিরোনামে কলাম লিখলেন। তিনি লিখলেন, “. . যাহারা ব্যক্তি পূজা করেন, . . তাহারা শেষ পর্যন্ত স্তাবকে পরিণত হয়। তাহাদের আত্মসম্মানবোধ বা বিবেক বলিয়া কিছু অবশিষ্ট থাকে না। . . . .স্তাবক শ্রেণীর লোকেরা কোনদিন যুক্তির ধার ধারে না, ইতিহাস হইতে শিক্ষা গ্রহণের মনোবৃত্তি তাহাদের নাই। আমাদের দুর্ভাগা দেশে মুষ্টিমেয় চিহ্নিত স্তাবক যে কত অনর্থ ঘটাইয়াছে তাহার হিসাব-নিকাশ কেইবা করিবে?”
রাজনীতি হতে হবে জনগণলগ্ন। তবে তার সময়ের পাকিস্তানি রাজনীতিতে সরকার ও জনগণ ছিলো বিছিন্ন, যা তার আক্ষেপের কারণ ছিলো। তিনি লিখেছেন, “বর্তমানে পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন দলও জনসাধারণের মধ্যকার যোগসূত্র যেভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে, সেই যোগসূত্রকে পূন:গ্রথিত করাকেই আমি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করি।” তবে পাকিস্তানি আমলের সারাটি সময় সরকার থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন ছিলো, বিশেষ করে তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ; আর তা-ই ছিলো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রধানতম কারণ। জনগণের প্রতি অবিচল আস্থাই ছিলো মানিক মিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের মর্মশাঁস। সে কারণে তাঁর উপলব্ধ সত্য, “A constitution grows from within, with public confidence, trust, respect and support. Anything imposed, especially when the act of imposition lacks sincerity of purpose, carries the seed of its own destruction.” বোধগম্য, কটাক্ষটি ছিলো আইউব-এর ১৯৬২-র সংবিধান সম্পর্কে। এমন মানসিকতার মানিক মিয়া ১৯৬৩-র ৮ নভেম্বর ছাত্রলীগের সম্মেলনে যে ভাষণ দেন, তা পরে ছাপা হয়েছে “সর্বমানবের সার্বভৌমত্ব” শিরোনামে, এবং তা বক্তব্য-বিষয়ের সারার্থ অনুযায়ী। মানিক মিয়ার এমন চিন্তার সঙ্গে ফরাসি দার্শনিক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮) General will বা মানুষের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
মানিক মিয়া পাকিস্তানে যে সরকার-জনগণ বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন, সে সম্পর্কে কিছু আলোচনার অবকাশ আছে। ইদানিং জনপ্রশাসনে বলা হয়, কৌশলমূলক যোগাযোগ (strategic communication)। অর্থাত্ সরকারি কর্মকান্ডে গণসম্পৃক্ততা বর্তমানে সারা বিশ্বে সরকারি কাজে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটি কতটুকু রক্ষিত হয়, তা প্রশ্নসাপেক্ষ; সাম্প্রতিক বাংলাদেশে রক্ষিত হয় কীনা তা বিবেচ্য। আসলে জনগণের প্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকা এখন ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছে। মনে হয়, বিষয়টির গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।
মানিক মিয়ার রাজনৈতিক দর্শনে ছাত্ররাজনীতির স্থান ছিলো। তিনি একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার্থীর উচিত সর্বক্ষণিকভাবে লেখাপড়া করা। কিন্তু তবুও তারা রাজনীতি করে, এবং তা মানিক মিয়া সমর্থন করেন। কেন? তার কথাতে উত্তর আছে, তিনি বলছেন, “. . মানবতার অবমাননা, সত্য ও ন্যায়ের অপমান অনুভূতিপ্রবণ ছাত্রসমাজের চিত্তে দোলা না দিয়ে পারে না।” রাজবাড়ি কলেজে ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে ১৯৬৮ তে দেয়া এই ভাষণে মানিক মিয়া ছাত্ররাজনীতি সমর্থন করতে গিয়ে আরও বলেছিলেন, “ছাত্র আন্দোলনকে ‘ছেলেমানুষি’ বা মহল বিশেষের ‘উস্কানি প্রসূত’ বলে যারা উড়িয়ে দিতে চান, আসলে তাঁরা সত্যকে পাশ কাটিয়ে যেতে চান।” তবে ছাত্ররাজনীতিকদের জন্য সতর্কবাণীও ছিলো; তারা “কোন রাজনৈতিক দলের বি-টিম” হিসেবে কাজ করবে না; এবং “ছাত্র ও যুব সমাজের নিরপেক্ষ স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী ও নি:স্বার্থ ভূমিকার ঐতিহ্যকে অমলিন রেখেই তা [ছাত্ররাজনীতি] করতে হবে।” এখন তো ছাত্ররাজনীতি মানেই জাতীয় রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি; ছাত্র সংগঠন এখন তো বি-টিম বই আর কিছু নয়।
মানিক মিয়ার রাজনৈতিক দর্শনে নেতৃত্ব প্রসঙ্গও আছে। তার দুটো মন্তব্য বেশ প্রাসঙ্গিক। যেমন, “ইতিহাসের ধারা নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয়। ইতিহাস তার গতিপথে কোন স্বেচ্ছাচার সহ্য করে না; কোন অন্যায় ও অপরাধ ক্ষমা করে না।” আরও একটি মন্তব্য বেশ সরাসরি এবং ইঙ্গিতবাহী “দেশের যারা ‘কর্ণধার’ তাদের উদ্দেশে বলি, লৌহবর্মের আড়ালে দাঁড়িয়ে, ‘স্ট্রংম্যান’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার চেয়ে মানুষের কাছে ‘মানুষের নেতা’ হিসেবে পরিচিত হতে প্রয়াসী হোন। দেখবেন, সব সমস্যার সমাধান আপনার-আমার সকলেরই নাগালের মধ্যে।” বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় মন্তব্যটি ‘স্ট্রংম্যান’ আইউব খানকে ইঙ্গিত করে। মনে হয়, মানিক মিয়ার বিবেচনায় নেতৃত্ব মানে তা, যা করিগুরু রবীন্দ্রনাথ-এর পঙক্তিতে আছে-- মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,আমি তোমাদেরই লোক।
পাকিস্তানি রাজনীতি
মানিক মিয়া পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন; বই লিখেছেন এই বিষয় নিয়ে, পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর। পাকিস্তানি রাজনীতির সবটুকু তিনি দেখে যেতে পারেন নি, বাংলাদেশ হওয়ার আগেই তিনি লোকান্তরিত হন ১৯৬৯-এ। তবে তাঁর বইতে এবং বিভিন্ন উদ্দেশে করা মন্তব্য বেশ লাগসই ছিলো। প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ মানুষদের বক্তব্য-মন্তব্য চিরকালিন ও সর্বজনীন; এমন মানুষেরা হন চিরকালিন ও সর্বজনীন।
মানিক মিয়া হাজার মাইলের ব্যবধানে দুটি প্রদেশ নিয়ে যে, পাকিস্তান, তাকে “একটি বিচিত্র রাষ্ট্র” বলেছেন। সব দিক দিয়ে অমিল দুটি প্রদেশের মধ্যে এক মাত্র যোগসূত্র না কী ছিলো ইসলাম। এমন প্রচারণার সঙ্গে মানিক মিয়া দ্বিমত পোষণ করে বলেন, “. . যাঁরা মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশ্নকে বাদ দিয়া শুধু ধর্মের উপর অনাবশ্যক গুরুত্ব প্রদান করিতে চান, তাঁহারা আদতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য-নীতির প্রশ্রয় দিবারই পক্ষপাতী তিনি আরও বলেন, “. . পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে আমাদিগকে মূল লাহোর প্রস্তাব হইতে অনেকখানি সরিয়া আসিতে হয়।” তাঁর দুটো মন্তব্যই ঐতিহাসিক। এক, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সম্পূর্ণ মেয়াদকালে ইসলাম ধর্মের অজুহাতে বাঙালির ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করেছে। অবশ্য তারা ইসলামের সবচেয়ে বেশি অবমাননা করেছে’ ৭১-এ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। দুই, লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো, ‘স্টেট্স’-এর কথা; আর দিল্লি মুসলিম লেজিসলেটরস্ কনফারেন্সে (৭-৯ এপ্রিল ১৯৪৬) তা হয় ‘স্টেট’, এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম হয় এভাবে। সুতরাং পাকিস্তানের জন্ম বিকৃতির মধ্য দিয়ে; তার স্বল্পমেয়াদী টিকে থাকা বিকৃতির মধ্য দিয়ে। কাজেই আনুপূর্বিক পটভূমিতে বলা যায়, বাংলাদেশের জন্ম লাহোর প্রস্তাবের এক ধরণের বিলম্বিত বাস্তবায়ন।
বিকৃত পাকিস্তানে কেমন চলছিলো, তা মানিক মিয়ার লেখা থেকে পরিষ্কার হয়, “প্রশ্ন জাগিয়াছে, কেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক বিমাতাসলভ আচরণ? কেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা, প্রাদেশিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ? কোন্ অধিকারে বা কোন্ দাবিতে পাকিস্তানের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্য? সত্যই কি আমরা ভুল পথ অনুসরণ করিয়া চলিয়াছি না, যাঁহারা বার বার প্রেফতার ও নির্যাতন করিতেছেন, তাঁহারা ভুল পথ অনুসরণ করিতেছেন?”
মানিক মিয়ার জীবদ্দশায় এক ইউনিট, সামরিক শাসন, আইউব-এর ১৯৬২-র সংবিধান, মৌলিক গণতন্ত্র এবং ১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছিলো; মানিক মিয়া সবকিছুর বিরোধী ছিলেন। কারণ তিনি গণতন্ত্রমনস্ক ও শান্তিপ্রিয় ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিলো, নির্দ্ধারিত সময়ে নির্বাচন হলে ১৯৫৮-র সামরিক শাসন হতো না। আর ১৯৬২-র সংবিধান ও মৌলিক গণতন্ত্র আইউব-এর ক্ষমতালোভী চিন্তাধারার ফসল। মানিক মিয়া প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে বিরোধী দলীয় প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করেছিলেন, তা আইউব-এর স্বৈরাচার থেকে নিষ্কৃতি পেতে। কিন্তু আইউব জয়ী হন ছলে-বলে-কৌশলে।
মানিক মিয়া পাকিস্তানের সমস্যা-সংকট নিরসনের উপায় হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন “কনফেডারেশন ধরনের শাসনতন্ত্র”, যা লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) এবং ছয় দফায় (১৯৬৬) ছিলো। তাঁর বিস্তৃত বক্তব্য ছিলো, “. . অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক নির্যাতনের কারণে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে, তাহা দূর করিতে হইলে কনফেডারশনের সুপারিশই করা উচিত। . . . . পক্ষান্তরে জোর-জুলুম কিংবা উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া কোন প্রস্তাবে তাহারা [বাঙালিরা] সম্মত হইবে না, বরং সন্দেহ-অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে।” তিনি প্রকারান্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের কারণ ও পটভূমি নির্দেশ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবিত ১৯৬৬-র ৬ দফায় মানিক মিয়া নতুনত্ব ও অভিনবত্ব খুঁজে পাননি।৩৫ ১৯৫৩ (১৯৫০?)-তে অনুষ্ঠিত গ্র্যা– ন্যাশনাল কনভেনশনে লিয়াকত আলী খান- এর মূলনীতি প্রতিবেদনের বিকল্প প্রতিবেদনে যে প্রস্তাব করা হয়, তাতে এই দাবি ছিলো। আবার ১৯৫৪-র প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফন্টের ২১ দফার ১৯ নম্বর দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিলো। ১৯৫৭-৫৮ তে সাপ্তাহিক নতুন দিন (বঙ্গবন্ধু সম্পাদিত) পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু ধারাবাহিক যা লিখেছেন। তার প্রতিফলন ৬ দফায় ছিলো।
৬ দফা পেশ করতে মানিক মিয়ার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু লাহোর গিয়েছিলেন। সে কথা ওপরে বলা হয়েছে। ৬ দফার চূড়ান্ত রূপ তিনি না দেখলেও এর সপক্ষে শক্তিময় কলম ধরেছিলেন। কারণ হলো, তাঁর চিন্তা ও ৬ দফার নিহিতার্থের মধ্যে সাযুজ্য। তিনি ৬ দফার মর্মকাথা ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে কথা হল, আসলে ৬ দফা পরিকল্পনার লক্ষ্য? সংক্ষেপে বলতে গেলে, সামগ্রিকভাবে দেশের স্বার্থকে বুলন্দ করবার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে জনসাধারণকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে দেশের দুই অঞ্চলের সমান অধিকার, সমান মর্যাদা ও সমান ক্ষমতা নিজ নিজ অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা তদারকের অধিকারী করে জাতীয় জীবনে অধিকতর ঐক্য ও সংহতি বিধান এ কর্মসূচির লক্ষ্য। দেশকে দুর্বল করা নয়, বরং দেশের দুই অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে অংশীদারিত্বের মনোভাব সৃষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করে দেশ ও রাষ্ট্রকে সত্যিকার শক্তিশালী করাই ৬-দফা কর্মসূচির মর্মকথা।
মানিক মিয়া যেভাবে ৬ দফার মর্মশাঁস উপলব্ধি করেছিলেন, সেভাবে পাকিস্তানি শাসকরা বুঝতে চাননি; তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিলো, বিচ্ছিন্নতাবাদের পরিকল্পনা মাত্র। আসলে গরম মাথার পাকিস্তানিরা স্থিতধী বঙ্গবন্ধুর ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনার মর্মার্থ বুঝতে চায়নি।’ ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিলো আসলে গরম মাথা আর ঠান্ডা মাথার লড়াই; ঠান্ডা মাথার বিজয় ছিলো অনিবার্য। তবে মানিক মিয়ার উপলব্ধিটি সঠিক ছিলো; পাকিস্তান ভেঙেছে পাকিস্তানিদের হঠকারিতার কারণে।
রাজনীতিমনষ্ক মানিক মিয়ার উপলব্ধির রাজনৈতিক দর্শনে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও তৃতীয় দুনিয়ার কথাও ছিলো। নীতিহীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে তাঁর খোলামেলা বক্তব্য ছিলো, “আধুনিক দুনিয়ায় নীতির স্থান নাই বলিলেই চলে। বিশেষত; বৃহত্তর শক্তিবর্গের কাছে নীতির মূল্য নিতান্ত অকিঞ্চিত্কর। ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ এবং ‘যেন-তেন প্রকারেণ’ স্বীয় দল ভারী করাই এদের লক্ষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা শক্তিবর্গ এবং কম্যুনিষ্ট দুনিয়া; সকলের বেলায়ই এই নীতিহীনতা লক্ষণীয়। তৃতীয় দুনিয়ার রাজনীতিতে মানুষ গৌণ, যে কথা মানিক মিয়া বলেছেন। তৃতীয় দুনিয়ার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর উচিত নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা। এই নীতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অবশ্য নিরপেক্ষতার অর্থে আমি নিষ্ক্রিয়তা বুঝাইতেছি না। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষায় ‘সকলের সহিত মৈত্রী, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’ ইহাই হইল রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতার মর্মকথা। মোটকথা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে যখন যে নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন তখন সেই নীতি অনুসরণ করাই নিরপেক্ষতা। কিন্তু বৃহত্তর শক্তিবর্গের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিজকে জড়িত করা কোনক্রমেই উচিত নয়। কারণ, একজনকে মিত্র হিসেবে পাইলেও অন্যজন শত্রু হইয়া দাঁড়াইবে। বোধগম্য, মানিক মিয়া জোটনিরপেক্ষ নীতির মর্মার্থ উপলব্ধি করেছিলেন।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা
পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর বইয়ের ‘গ্রন্থকার পরিচিতি’ অংশে লেখা হয়েছে মরহুম তফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। মূলত: তিনি ছিলেন রাজনীতিক। রাজনীতি করার জন্য তিনি সরকারী চাকরি ত্যাগ করেন এবং রাজনীতি করার জন্যই সাংবাদিকতার অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তবে সক্রিয় রাজনীতির পন্থা তিনি গ্রহণ করেননি। তার রাজনীতি ছিল স্টেটস্ম্যানের (statesman) রাজনীতি, পলিটিশিয়ানের (politician) নয়।
উপর্যুক্ত মন্তব্যে মানিক মিয়ার সাংবাদিকতার কারণ ও পটভূমি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বিবেকী সাহস-উত্সারিত সাংবাদিকতার পথিকৃত্। তাঁর ‘মোসাফির’ কলম-নামের ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয় এদেশের কলাম-সাহিত্যকে পথ দেখিয়েছে। তার কলামে পাকিস্তানের নয় শুধু, সারা বিশ্বের সমাজ-রাজনীতির কথা থাকতো। একজন বিবেকী মানুষের চিন্তাশীলতার নানা মাত্রা বিধৃত হয়ে আছে তার লেখায়/কলামে। তার কলামে/লেখায় লেজুড়বৃত্তি বা স্তাবকতার লেশমাত্র ছিলো না; ছিলো বিবেক-উত্সারিত সাহসী সত্য উচ্চারণ। চিন্তাধারার স্বচ্ছতা, লক্ষ্যের অভ্রান্ততা আর বক্তব্যের অকাট্যতা তাঁর লেখনীর বৈশিষ্ট্য ছিলো। জগত ও জীবন সম্পর্কে তার ঋদ্ধ মন ও মননও লক্ষণীয়।
মানিক মিয়ার কলাম লেখা নিয়ে একটি চমকপ্রদ কাহিনি আছে। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক মওলানা ভাসানী; মানিক মিয়া সহকারী। ভাষা আন্দোলনের সময়ে মানিক মিয়া মওলানা ভাসানীকে রাজি করিয়ে একটি উপসম্পাদকীয় লিখলেন, যার শুরুতে কথাগুলো ছিলো, “বেড়ালে নূরুল আমীনের চোখে মুতিয়া দিয়াছে;ইহার জন্য তিনি দেখিতে পাইতেছেন না . . . .।” বলা বাহুল্য, মানিক মিয়ার পাঠকপ্রিয়তার সূচনা সেই থেকে। কলামটির তাত্ক্ষণিক সাফল্যে অভিভূত মওলানা ভাসানী বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “তুই তো ভালোই লেখস।”
মানিক মিয়া নিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। তার একটি প্রবন্ধ-সংকলনের শিরোনাম সংবাদপত্রের স্বাধীনতা (১৯৮৮)। তবে বক্তব্য বেশ খোলামেলা, “শৃঙ্খলিত সংবাদপত্র শৃঙ্খলিত জনসমাজেরই প্রতীক। শৃঙ্খলিত জনসমাজের আত্মবিকাশ যেমন অসম্ভব, তেমনিভাবে স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি-মানসেরও স্ফূরণ ও অকল্পনীয়। এক কথায়, স্বাধীন সংবাদপত্রের অস্তিত্ব ছাড়া একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা কষ্টকর।”
তবে মানিক মিয়া স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচার বোঝাতে চাননি। যেমন তার বক্তব্য, “. . সমাজের অন্যান্য অংশের ন্যায় সংবাদপত্রও নির্দোষ কিংবা ত্রুটিমুক্ত নয়। ত্রুটি একেবারেই থাকবে না, এটা কোনকালেই সম্ভব হতে পারে না। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, সংবাদপত্রের মহান ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদপত্রের পক্ষে আত্মসংযম একান্ত বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সেই আত্মসংযম থাকতে হবে স্বত:প্রবৃত্ততার উপর।”
তরুণদের ওপর আস্থা
মানিক মিয়া সারা বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করে তারুণ্যের অপরিমেয় এবং দুর্দম শক্তির ওপর আস্থাশীল ছিলেন; এবং তা তার উপলব্ধ সত্য ছিলো। ১৯৬৩-র ৮ নভেম্বর, অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমরা যারা ঘটমান বর্তমানের মনোযোগী পর্যবেক্ষক তারা জানি, দিকে দিকে গণশক্তির অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটেছে। এই জাগরণের সারথী হচ্ছে তারুণ্য--তরুণের দল। যুগ যুগ ধরে তাদের দ্বারাই অসাধ্য সাধন হচ্ছে। আমি দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করি, এই দুরন্ত দুর্দম তরুণশক্তি কোথাও কোন অন্যায়, অবিচার ও অসাম্যকে মেনে নেবে না। এই পৃথিবীকে তারাই করে তুলবে সুন্দর, তারাই বাস্তবায়িত করবে আবহমানকালের মানুষের স্বপ্ন ও সাধের সমাজ।”৪৫ মানিক মিয়ার প্রতীতি ও উপলব্ধ সত্যজনিত কথাগুলো। ইতালী একত্রিরণের জনক ম্যািসনিও এমনভাবে তারুণ্যের শক্তিতে আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু তাঁরা, বিশেষ করে, মানিক মিয়া এখন বাংলাদেশে কি এমন কথা বলতে পারতেন? সংশয় আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বাংলাদেশের তারুণ্য এখন ভুল রাজনীতির খপ্পরে পড়ে অপচয়িত ও অবক্ষয়িত। তাদেরকে ঠিক পথে পরিচালিত করার নেতৃত্ব দৃশ্যমান নয়।
ব্যক্তিত্ব মূল্যায়ন
মানিক মিয়া এটা সত্য হিসেবে জানতেন যে, মানুষই ইতিহাসের চালিকা-শক্তি। অবশ্য তিনি এটাও জানতেন যে, কিছু মানুষ ঘটনা সংঘটনকারী হিসেবে ইতিহাসের মঞ্চে কুশীলব হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। মানিক মিয়া তার স্বল্পায়ু যাপিত জীবনে এমন অনেক মানুষের সংশ্রবে এসেছেন; তাদের সম্পর্কে তাঁর ইতি-নেতিবাচক মূল্যায়ন আছে। আবার অনেককে তিনি দূরদর্শনেই তাদের কর্মকান্ডের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন; তাদের ওপর তার পর্যালোচনামূলক লেখা আছে। মানিক মিয়া মিশেছেন অনেক মানুষের সাথে; তার লেখায় তারা আছেন ভিড় করে; তাদের সবার কথা বলা এখানে সম্ভব নয়, কিছু বড় মাপের মানুষের কথা আছে মোটা দাগে। শেখ মুজিব-এর কথা আলাদাভাবে কিছু বলা নেই, কিন্তু দু’জনের আন্ত:সম্পর্কের নৈকট্য সবারই জানা। দু’জনের রাজনৈতিক চিন্তার সাযুজ্যও কারও অজানা নয়; উভয়ই বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তি প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু বড় মাপের মানুষের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যে তাঁর পছন্দের মানুষ ছিলেন না, তা বোধগম্য। বোধগম্য এ কারণে যে, রাজনৈতিকভাবে দু’জনের দুটি পথ ছিলো বাঁকা; মানিক মিয়া মধ্যডান, আর ভাসানী বাম। তবে দু’জনের রাজনীতি ছিলো বাঙালিপন্থী। ভাসানীর কাগমারী সম্মেলন (৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) মানিক মিয়ার পছন্দ ছিলো না; তাঁর পছন্দ ছিলো না তোরণ ও ফেস্টুন। তবে মানিক মিয়ার ভালো লেগেছিলো যখন ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় বললেন, পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান না করলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলে বিদায় জানাবেন। মানিক মিয়া চেয়েছিলেন, কাগমারীতে নয়, ঢাকায় হোক সম্মেলনটি।
তবে সবার চেয়ে মানিক মিয়ার নমস্য ছিলেন সোহরাওয়ার্দী, এবং তা যুক্তিসঙ্গত কারণে। সোহরাওয়ার্দী তার রাজনৈতিক চিন্তা ও মনন গঠনের পথ-প্রদর্শক ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী লোকান্তরিত হবার পর মানিক মিয়া কলমী-শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বেশি। ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৭, The Pakistan Observer-এ তিনি লিখলেন, “We adore him for his democratic beliefs and struggles. We salute him for the sufferings he underwent for the cause of democracy and for the welfare of the people.” কথার স্বল্পতায় বিধৃত এক মহাজীবনের মূল্যায়ন! ১৯৬৪-র মার্চ মাসে তাঁর পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সোহরাওয়ার্দী সংখ্যায় প্রকাশিত মানিক মিয়ার লেখার শিরোনাম ছিলো “সমুদ্রের পরিমাপ যেমন সম্ভব নয়’। যথার্থ শিরোনাম! সোহরাওয়ার্দীর লোকান্তরণের পর তিনি যথার্থই পাকিস্তানকে নেতৃত্বশূন্য বলেছিলেন। মানিক মিয়ার বিবেচনায় সোহরাওয়ার্দী ছিলেন দুই প্রদেশের “একমাত্র সেতুবন্ধন।” তবে বিবেকী মানুষ মানিক মিয়া সোহরাওয়ার্দীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দেবতা-দর্শনের মতো নত হননি; মানিক মিয়ার সমালোচনার তীর সোহরাওয়ার্দীকে বিদ্ধ করেছে ক্ষেত্রবিশেষ যেমন তিনি লিখেছেন, “তিনি [সোহরাওয়ার্দী] পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বঞ্চনার অস্তিত্বের কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু সমস্যবলী সমাধানের বা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই, অথচ তিনি তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া অতি সহজেই এসব প্রশ্নের সীমাংসা করিতে পারিতেন।”
মানিক মিয়া ড. মুহাম্মদ ইকবাল-এর কবি সত্তার পর্যাপ্ত স্বীকৃতি দিয়েছেন, তবে প্রশ্ন তুলেছেন তার পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা খ্যাতি প্রসঙ্গে, “. . কিন্তু তাঁহাকে যদি পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টারূপে গ্রহণ করিতে হয়, তবে বলিতে হয় যে, তাহার পরিকল্পনা আদৌ স্পষ্ট ছিল না। এমন কি, তাঁহার স্বপ্নে ভারতের পূর্বাঞ্চল বা পূর্ব পাকিস্তানের কোন স্থানই ছিল না; বরং বিভিন্ন সময়ে ভারতের অখন্ডতার জয়গান গাহিয়াছেন: কখনও বা বিশ্বকবি হিসাবে “সারা জাঁহাছে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা” অথবা “চীন ওয়া আরব হামারা হিন্দুস্তাঁ হামারা-এই ধরনের ভাবধারারও পরিচয় দিয়াছেন।”
মানিক মিয়া মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতির জনক বলা সত্ত্বেও তার সম্পর্কে তীর্যক বক্তব্য ছিলো: “জিন্নাহ সাহেবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্বন্ধে কোন বিতর্ক নাই, কিন্তু যাহারা স্বাধীনতা আন্দোলনে জনগণের ভূমিকাকে তুচ্ছ স্থান দিয়া ব্যক্তি বিশেষের নেতৃত্বকে ফুলাইয়া-ফাঁপাইয়া তুলিতে প্রয়াসী তাহারা রাজনৈতিক এতিম, নয় গণবিরোধী।”৫৩ জিন্নাহ-নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা এমন বক্তব্যে পরস্ফূিট। আর যাহোক, জিন্নাহ জননেতা ছিলেন না।
কঙ্গোর নেতা প্যট্রিস লুমুম্বার হত্যা (১৯৬১) (জন্ম ১৯২৫) নিয়ে মানিক মিয়া ১৯৬১-র ১৮ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক -এ লিখলেন বড় পরিসরে; “শুধু এশিয়া-আফ্রিকা কেন, লুমুম্বার হত্যাকা– নিয়া খোদ মার্কিন মুল্লুকে নিগ্রোদের মধ্যে কী প্রচন্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইয়াছে, জাতিসংঘ ভবনে সীমাবদ্ধ বিক্ষোভ হইতে তাহা কিছুটা আঁচ করা যায়।”
১৯৬৬-র ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত হলো মানিক মিয়ার নেহরুর মৃত্যুর (১৮৮৯-১৯৬৪) পর লেখা। তিনি লিখলেন, “যাহাদের জীবন সত্যিকারের মানব কল্যাণে উত্সর্গিত হয়, তাহারা মরিয়াও অমর। নেহরুর মৃত্যুতে আজ গোটা দুনিয়া শোকাভিভূত। এই শোকের ছায়া কাটিয়া যাইতে না যাইতেই ভবিষ্যত্ রাজনীতি লইয়া নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হইয়াছে।” সুতরাং মানিক মিয়া যেন উপদেশের ঢংয়ে লিখলেন, “. . ভারতে এমন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হউক -যাহারা অন্তত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিবেনা, কিংবা যুদ্ধবাজদের এই অঞ্চলে ঠাঁই পাইতেও দিবেন না। তাহা হইলে পাক-ভারত উপমহাদেশের সংখ্যালঘু সমস্যা --- এমনকি কাশ্মীর সমস্যাও শান্তিপূর্ণ পথে সমাধান সম্ভব হইতে পারে।” মানিক মিয়ার স্বপ্ন তো অপূর্ণ থেকে গেলো: ভারতের নেতৃত্বে এখন ধর্মভিত্তিক একটি গোঁড়া সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। নেহরু যে ভারত নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন, তা এখন উধাও; অবশ্য নেহরুর নীতি ও কর্মে ত্রুটি ও ভ্রান্তি ছিলো না, তা নয়। মানিক মিয়া সামগ্রিক বিচারে নেহরুকে শ্রদ্ধা করতেন।
সমাপনী মন্তব্য
দৈনিক ইত্তেহাদ- এর পরিচালনা বিভাগে সেক্রেটারী হিসেবে যোগদানের পর মানিক মিয়া সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেছিলেন, “মানিক মিয়া সত্যি মানিক --- সাংবাদিকতায় এর অভিজ্ঞতা নাই সত্য, কিন্তু অফিস ম্যানেজমেন্টে এর দক্ষতা দেখিয়া তোমরা মুগ্ধ হইবে।” সোহরাওয়ার্দী মানুষ চিনতেন, প্রতিভার কদর করতেন। তার প্রমাণ যারা দুজনই বিশেষভাবে স্নেহধন্য ছিলেন; মানিক মিয়া ও শেখ মুজিবুর রহমান, তারা ভাবীকালে স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্মনামখ্যাত হয়েছিলেন। এ দুজনের কাছে বাংলাদেশের অপরিমেয় ঋণ, মানিক মিয়ার কাছে সাংবাদিকতার জন্য: শেখ মুজিবুর রহমান-এর কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, এবং তাকে গড়ে তোলার পথ দেখানোর জন্য। তবে মানিক মিয়া শুধু “অফিস ম্যানেজমেন্টে” তার পারঙ্গমতা দেখাননি, তিনি কালে কালে হয়ে উঠেছিলেন সাংবাদিককুল শিরোমণি। মানিক মিয়া তার স্বল্পায়ু জীবনে বলেছেন/লিখেছেন কম; কিন্তু তাঁর বলা/লেখায় ছিলো বিন্দুতে সিন্ধুর গভীরতা। কারণ প্রচুর পাঠ ও অনুধ্যানজনিত তাঁর ছিলো সমৃদ্ধ মন ও মনন। অভিন্ন কারণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো স্বচ্ছ ও বক্তব্য/মন্তব্য লাগসই এবং লক্ষ্যাভিসারী। সর্বোপরী, তিনি ছিলেন শুধু সংবাদপত্রের নয়, মানুষের খ্যাতকীর্তি সাংবাদিক। সাংবাদিক হিসেবে মানিক মিয়ার হিমাদ্রিসম উচ্চতা আজও অনতিত্রম্য। এমন কারণসমূহ বিবেচনায় রেখে যশস্বী ব্যক্তিত্ব আবুল মনসুর আহমদ মানিক মিয়ার লোকান্তরণের পর যে লেখা লিখেছিলেন, তার শিরোনাম ছিলো, “জাতি যে মানিক হারাইল।” উল্লেখ্য, মানিক মিয়াকে চিনেছিলেন ও বুঝেছিলেন তিনজন -- সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু ও আবুল মনসুর আহমদ; তিনজনের কাছেই তিনি ছিলেন ‘মানিক।’ আমরা কী মানিক মিয়ার ‘মানিকত্ব’ চিনেছি বা বুঝেছি?
লেখক: চেয়ার অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)