কলসির তলায় ছোট্ট ছিদ্র থাকিলে খুব বেশি সমস্যা হয় না; কিন্তু সেই ছিদ্র যদি বড় হয় এবং ছিদ্রর সংখ্যা ও আয়তন যদি দিনদিন বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলে সেই কলসির পানিশূন্য হইতে অধিক সময় লাগে না। তেমনি মানুষের শরীরেও যদি কোথাও নীরবে রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলে যতই আয়রনসমৃদ্ধ ভালো খাবার খাওয়া হউক না কেন, শরীরের ফ্যাকাসে বর্ণের পরিবর্তন হইবে না। ঠিক একইভাবে একটি অনুন্নত রাষ্ট্র যখন ক্রমশ উন্নয়নের সোপানে পা রাখিতে শুরু করে তখন রাষ্ট্রটি হয় ঐ কলসি বা মানবশরীরের মতো—যাহার ভিতরকার দুর্নীতি নামক ছিদ্র বা রক্তক্ষরণ আটকাইতে হয়। নচেত্ বাহির হইতে যতই পানি ঢালা হউক, যতই শরীরে লিটার লিটার রক্ত প্রবেশ করানো হউক—ফ্যাকাশে চিত্রের পরিবর্তন হইবে না।
স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরের ইতিহাসে খাদ্য উত্পাদন, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়ই উন্নতি ঘটিয়াছে; কিন্তু ইহার পাশাপাশি গত অর্ধশতকে বিচিত্র ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে নীরব রক্তক্ষরণ ঘটিয়াছে। সর্বশেষ নির্বাচনি ইশতেহারে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করিয়াছিল। অতীতের সকল সরকারই দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলিত; কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘লাল ঘোড়া’ ছুটানো যেন কথার কথা। দুর্নীতি-অনিয়ম অপচয়ের কারণে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি কত বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হইয়াছে—ইহার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বা তথ্য নাই। সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ দেওয়া যায়। যেমন ২০০১ হইতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বত্সর বাংলাদেশ বিশ্বের সবচাইতে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করিয়াছিল। অন্যদিকে গত বত্সর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে—ত্রুটিপূর্ণ নকশা, সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, বাড়তি কাজ, সুষ্ঠু নেতৃত্ব ও তদারকির অভাব, তহবিল পাইতে বিলম্ব ও অন্যান্য কারণে ১০টি মেগা-প্রকল্পের খরচ বাড়িয়াছে ৫২ হাজার কোটি টাকারও অধিক। একটি প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় নাই। প্রশ্ন হইল, কেন এত বিশাল পরিমাণ অর্থের অপচয় হওয়া সত্ত্বেও ইহার জন্য কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না? মনে রাখিতে হইবে—উল্লিখিত অর্থের অপচয়ের পরিমাণটি শুধু ১০টি আলোচিত প্রকল্প হইতে আসা। এই রকম অসংখ্য প্রকল্প রহিয়াছে। যেমন আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বিআরটি প্রকল্পের বিলম্ব যেইভাবে বত্সরে ১২ কোটি ৩০ লক্ষ ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি করিয়াছে, আট বত্সর বিলম্বের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াইবে, যাহা দিয়া এই ধরনের দুইটি বিআরটি করিডর নির্মাণ করা সম্ভব। অন্যদিকে আরো একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, আমদানি-রপ্তানির ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না-আনিবার মতো মূল সমস্যাগুলি যোগ করিলে দেখা যাইবে, প্রতি বত্সর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হইতে বাংলাদেশ বঞ্চিত হইতেছে।
অর্থাত অর্থনীতির ভিতরকার এই সকল নীরব রক্তক্ষরণ না থাকিলে দেশের অবয়ব যতখানি উজ্জ্বল হইতে পারিত, তাহার চাইতে অনেক কম হইয়াছে। অর্ধশতকের সামগ্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখা যাইবে, যাহারা যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তাহাদের দুর্নীতির ক্ষতগুলি কার্পেটের নিচে চাপা দেওয়া থাকে; কিন্তু যখন তাহারা ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া যায়, তখন চাপা দেওয়া কার্পেটের নিচ হইতে দুর্নীতির এমন সকল অতি ভয়াবহ তথ্য-ফিরিস্তি বাহির হইতে থাকে, যাহা ক্ষমতায় থাকিবার সময় সাধারণ মানুষ কল্পনাও করিতে পারে না।
তৃণমূল পর্যায় হইতে শুরু করিয়া উপর স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে যেই পরিমাণ অর্থের অপচয় ও অনিয়ম হইয়াছে, তাহা সঠিক ব্যবস্থাপনায় যদি হ্রাস করা সম্ভব হইত, তাহা হইলে সরকারকেও অর্থের জন্য বড় বড় অর্থ সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে হইত না। ইহার লাগাম টানিতে পারিলে আমরা হয়তো আরো উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়িয়া তুলিতে পারিতাম।