সাধারণত একটি দেশের অর্থনীতির আপদ বা সংকটকালীন প্রয়োজন মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে একটি দেশের অর্থনীতির শক্তি ও সামর্থ্য অনুধাবন করা যায়। অন্য কথায় বলা যায়, একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তি ও অবস্থান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্বারা প্রকাশিত হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কোনো দেশের সঙ্গে লেনদেন করার আগে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির যেসব সূচক বিবেচনা করে, তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য।
স্ফীত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে আমরা বেশ স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে করোনা-পরবর্তীকালে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে বেশ কয়েকটি খাতে অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন—এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ)সহ কয়েকটি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কিছু অর্থ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যক্তি খাতের কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিতে হয়েছে রিজার্ভ অর্থ থেকে। একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্য একপর্যায়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলেও আবারও তা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। আমদানিকারকদের কেউ কেউ ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিকালে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করছেন। আবার যারা পণ্য রপ্তানি করেন, তাদের কেউ কেউ রপ্তানিকৃত পণ্যের পুরো মূল্য দেশে না এনে বিদেশেই রেখে দিচ্ছেন। অর্থাত্, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে তারা উপার্জিত রপ্তানি আয়ের একটি অংশ বিদেশেই রেখে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় উত্স হচ্ছে রেমিট্যান্স। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকেরা প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান, তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে এবং রিজার্ভে যুক্ত হয়। পণ্য রপ্তানি বাবদ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, তার অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। তাই বলা যায়, তুলনামূলকভাবে পণ্য রপ্তানি আয়ের চেয়ে রেমিট্যান্স আয় বেশি সম্ভাবনাময়। কারণ এই খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে এবং রিজার্ভে যুক্ত হয়। করোনাকালীন অবস্থার আগে রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে যে গতিশীলতা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল, বর্তমানে তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স দেশে পাঠালে স্থানীয় মুদ্রায় যে টাকা পাওয়া যায়, অবৈধ বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পাওয়া যায়। ব্যাংকিং চ্যানেল ও কার্ব মার্কেটের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের মধ্যে এত উচ্চ পার্থক্য রয়েছে, যা অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে তা তুলনামূলক স্বল্প সময়ে এবং সহজে স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় মুদ্রায় বেশি অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন।
মূলত আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি না পওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে মন্থর গতির কারণেই মূলত রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। অন্যান্য বছর দেখা যেত, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলার বাজারে বিক্রি করত। স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার যাতে মার্কিন ডলারের তুলনায় অতিমাত্রায় কমে না যায়, তা নিশ্চিত করার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কিছু মার্কিন ডলার বাজারে বিক্রি করত। কিন্তু এখন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ স্বল্পতার কারণে মার্কিন ডলার বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক দুভাবে রিজার্ভ হিসাবায়ন করে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে গ্রস রিজার্ভ, অন্যটি নিট রিজার্ভ। রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডসহ বিভিন্ন খাতে দেওয়া ঋণের অর্থকে অন্তর্ভুক্ত করে গ্রস রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হয়। আর নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের সময় রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন খাতে দেওয়া অর্থকে বাদ দিয়ে দেখানো হয়। আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংককে নিট রিজার্ভ প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে। গ্রস রিজার্ভের চেয়ে নিট রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম। আমি মনে করি, আইএমএফ রিজার্ভ হিসাবায়নের যে পদ্ধতির কথা বলেছে, সেটাই যৌক্তিক। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৈধ পথে, অর্থাত্ ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় কার্ব মার্কেটে যত বেশি হবে, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠনোর আশঙ্কা ও প্রবণতা তত বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার রোধ করার জন্য চেষ্টা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে সফলতার হার খুব একটা বেশি নয় বলেই মনে হয়। হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় দেশে যাতে না আসে, সে জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে। কিন্তু কার্ব মার্কেটে যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় বেশি পাওয়া যায়, তাহলে অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে পাঠাবেন এটাই স্বাভাবিক। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরি।
দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে—এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায় কি না, নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কারণ আমাদের হাতে এসংক্রান্ত প্রমাণযোগ্য কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে নির্বাচনের আগে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তারা মনে করতে পারেন, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের অসুবিধা হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই একজন অর্থ উপার্জনকারী তার অর্থের নিশ্চয়তা খোঁজেন। একজন বিনিয়োগকারীও কখনোই অনিশ্চিত অবস্থায় কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। জাতীয় নির্বাচনকালীন অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত অবস্থায় অনেকের মধ্যেই তাদের উপার্জিত অর্থ অন্য কোথাও স্থানান্তরের প্রবণতা কাজ করবে এটাই বাস্তবতা।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে বিনিয়োগ কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ একজন বিনিয়োগকারী চাইবেন, যে দেশে বিনিয়োগ করবেন, সেখানে যেন পুঁজির নিরাপত্তা থাকে। তুলনামূলক মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকে। একজন বিনিয়োগকারী সব সময়ই ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু সেই ঝুঁকি যদি তার পুঁজি হারানোর মতো হয়, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সেখানে বিনিয়োগ করবেন না। কোনো দেশে যদি নির্বাচনকালীন বা অন্য কোনো সময় অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেই দেশে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী হচ্ছেন শীতের অতিথি পাখির মতো। শীতের অতিথি পাখি কোনো জলাশয়ে পর্যাপ্ত খাবার এবং জীবনের নিরাপত্তা না পেলে আশ্রয় গ্রহণ করে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তেমনি কোনো দেশে পর্যাপ্ত মুনাফা ও পুঁজির নিরাপত্তা না পেলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যে কোনো দেশে বিনিয়োগের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু স্থানীয় বিনিয়োগকারীগণ চাইলেই অন্য দেশে গিয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন না। এর জন্য তাদের সরকারি অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীগণ কী করবেন? স্থানীয় বিনিয়োগকারীগণ যেহেতু চাইলেই অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন না, তাই তারা এ ক্ষেত্রে ‘গো স্লো’ বা ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করে থাকেন। অর্থাত্, স্থিতিশীল পরিবেশের জন্য তারা অপেক্ষা করেন। অনিশ্চিত অবস্থায় একজন বিনিয়োগকারী কখনোই নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়, তাই এ সময় বিনিয়োগকারীগণ ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করে থাকেন। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হতে পারে। নীতির পরিবর্তন হতে পারে। তাই বিনিয়োগকারীগণ এ সময় নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত থাকেন। তাই নির্বাচনের বছর বিনিয়োগের গতি শ্লথ হবে এটাই স্বাভাবিক।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। অনুলিখন :এম এ খালেক