বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

৩৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভূমি জালিয়াতির মামলা

# ছয়টি ভুয়া বন্দোবস্ত বাতিল
# ভূমি বিভাগের ৩ কর্মচারী বরখাস্ত

আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:৪৬

নিজেদের নামে বন্দোবস্ত দেখিয়ে ভূমি অধিগ্রহণভুক্ত করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টার অভিযো খাগড়াছড়ির রামগড় পৌরসভার বর্তমান ও সাবেক মেয়র, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং উপজেলা বিএনপির সভাপতিসহ ৩৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় ভূমি জালিয়াতির ছয়টি মামলা রুজু হয়েছে। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পৌর এলাকায় সরকারি খাস খতিয়ানের প্রায় ২৬ একর ভূমি ছয়টি ভুয়া হোল্ডিং সৃজন করে ভূমি অধিগ্রহণ করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।

জেলা প্রশাসকের নির্দেশে রামগড় উপজেলা ভূমি অফিসের অফিস সহকারী কবির আহম্মদ বাদী হয়ে বুধবার মধ্যরাতে এসব মামলা দায়ের করেন।

এর আগে ছয়টি ভুয়া হোল্ডিং ও বন্দোবস্ত মামলা বাতিল করা হয়। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ভূমি বিভাগের তিনজন কর্মচারীকে বরখাস্ত ও অপর তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মঞ্জুরুল আলম সাংবাদিকদের এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। রামগড় থানার ওসি (তদন্ত) মো. শফিকুল ইসলাম ছয়টি মামলা রুজুর বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, তিনজন আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য একটি ভূমি জালিয়াত চক্র ভূমি বিভাগের উপজেলা ও জেলা অফিসের অসাধু কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ছয়টি ভুয়া হোল্ডিংয়ে ২৫ দশমিক ৯১ একর ভূমির ভুয়া বন্দোবস্ত নেয়। রামগড় পৌরসভার ২২৯ নং রামগড় মৌজার অধীনে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়কের সোনাইপুল থেকে রামগড় বাজার পর্যন্ত এলাকায় রাস্তার দুইপাশের ১ নং সরকারি খাস খতিয়ানভূক্ত ২৫ দশমিক ৯১ একর ভূমি দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ছয়টি ভুয়া হোল্ডিং সৃজন করে। জালিয়াত চক্রটি ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে রামগড় উপজেলা ভূমি অফিস ও ২২৯ নং রামগড় মৌজার হেডম্যানের কার্যালয়ের জমাবন্দিতে কাটাকাটি, ঘঁষামাজা ও ওভাররাইটিং করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা উল্লেখ করে ভুয়া হোলিংয়ে বিভিন্ন পরিমাণে ২৫ দশমিক ৯১ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয় এবং মালিকানা স্বত্বের প্রতিবেদনে ওই ভূমি সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে অধিগ্রহণভূক্ত করা হয়।

আরও বলা হয়, ভূমি জালিয়াতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরের পরিপ্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসকের গঠিত কমিটির তদন্তে এসব জাল-জালিয়াতির ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হয়। ওই তদন্তে  উপজেলা ভূমি অফিস বা জেলা প্রশাসকের মহাফেজখানা শাখায় উল্লেখিত ছয়টি বন্দোবস্ত মামলার মূল নথি, কবুলিয়তসহ অপরাপর রেকর্ডপত্রের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

সূত্র জানায়, ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর ২০ সেপ্টেম্বর ওই ছয়টি ভুয়া বন্দোবস্তি মামলা বাতিল করেন জেলা প্রশাসক। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ছয়টি ভুয়া বন্দোবস্ত হওয়া ৩৬ জন কথিত ভূমির মালিক, ক্রেতা ও বিক্রেতার বিরুদ্ধে রামগড় থানায় পৃথক পৃথকভাবে ছয়টি মামলা রুজু করা হয়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ৪৬৫, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ও ৩৪ পেনাল কোডে বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ছয়টি মামলা রুজু করা হয়।

সূত্র জানায়, দায়েরকৃত ছয়টি মামলার মধ্যে একটিতে রামগড় পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রফিকুল আলম কামালসহ তার অপর তিন ভাইও  রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, ২২৯ নং রামগড় মৌজার ১ নং সরকারি খাস খতিয়ানভূক্ত ভূমিতে দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৭৮৬ সৃজন করে আব্দুল গফুর সর্দারের মেয়র কামালের বাবার নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নং ১৫৫/৬৯-৭০ উল্লেখ করে প্রথমে ৩ একর, এরপর ৪ দশমিক ৮৩ একর ও সর্বশেষ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ০৩ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয় এবং অধিগ্রহণের জন্য অর্ন্তভুক্ত করা হয়। একইভাবে  রামগড় পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহানসহ (কাজী রিপন) তার অন্য সাত ভাইবোনের নামেও একটি মামলা হয়েছে।

এতে উল্লেখ করা হয়, ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৭৯৫ (ক) সৃজন করে কাজী রিপনের বাবা কাজী রুহুল আমীনের নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর-১৪৫৫/৬৭-৬৮ উল্লেখ করে এক দশমিক ৭৪ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও খাগড়াছড়ি স্থানীয় সরকার পরিষদের সাবেক সদস্য ভুবন মোহন ত্রিপুরার নামে দায়েরকৃত মামলায় বলা হয়, ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৭৭১ সৃজন করে ভুবন মোহন ত্রিপুরার নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ৫০১৫৬/৬০-৭০ উল্লেখ করে ৬ দশমিক ৩৮ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়। পরবর্তীতে নুরের নবী চৌধুরী, মো. মোস্তফা ভুইয়া, শাহানার আক্তার, ছবুরা খাতুন, নুরুল ইসলাম, দীলিপ চন্দ্র রক্ষিত, মো. ফেরদৌস ইসলাম, সাজেদা খাতুন, ¯েœহ কান্তি চাকমা ও অবনী লাল ত্রিপুরার নামে নামজারী মামলা উল্লেখ করে ৫ দশমিক ৩৮ একর ভূমি বিক্রির ভুয়া নোটিং করা হয়। এই মামলায় উল্লেখিত ১০ ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়।

উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাফেজ আহমেদ ভুইয়ার নামে দায়ের করা মামলায়(নম্বর-১০) অভিযোগ করা হয়, ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ১১০৩ সৃজন করে  হাফেজ আহমেদ, ভাই মকবুল আহমেদ ও আহম্মদ করিমের নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ৪৭০/৭৮-৭৯ উল্লেখ করে ৩ দশমিক ৩৮ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়। এই বন্দোবস্তের ভূমি থেকে ক্রেতা হাছিনা আক্তার, ছবুরা খাতুন ও নুরুল ইসলামের নামে নামজারি মামলা নম্বর ৫৯/রাম/৯১ উল্লেখ করে ২ দশমিক ৬০ একর ভূমি বিক্রির ভুয়া নোটিং করা হয়। মামলায় হাফেজ আহমেদ ও তার ভাই আহম্মদ করিমছাড়াও ভাতিজা মো. মোস্তফা ভুইয়া ও তার স্ত্রী হাছিনা আক্তার, ছবুরা খাতুন ও নুরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। এছাড়া, ভুয়া হোল্ডিং নম্বর ৮৮৫ সৃজন করে রুহুল আমীনের নামে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা ১৪৩৪/৭৯-৮০ উল্লেখ করে ৪ দশমিক ৩১ একর ভূমি বন্দোবস্তের নোটিং করায় মৃত রুহুল আমীনের স্ত্রী নুর জাহান বেগম, মেয়ে রোকেয়া বেগম, জাহানার বেগম, নাজমা বেগম, রাশেদা বেগম, আছমা বেগম, জোবেদা আক্তার মুন্নি, ছেলে নুরুন্নবী ও মামুন হোসেনের নামেও মামলা হয়েছে। অন্য একটি মামলার আসামি কামিনি রঞ্জন ত্রিপুরা নামে এক ব্যক্তির নামে ভুয়া  হোল্ডিং নম্বর ৮৮৭ সৃজন করে ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা নম্বর ১৯১৫/৬৯-৭০ উল্লেখ করে ৫ দশমিক ০৭ একর ভূমি বন্দোবস্তের ভুয়া নোটিং করা হয়। এই ভুয়া বন্দোবস্ত ভূমি থেকে ক্রেতা হিসেবে ছবুরা খাতুন, তার ছেলে নুরুল ইসলাম, মোস্তফা ভুইয়া, শাহানা আক্তার, মো. ফেরদৌস ইসলাম, পারভিন আক্তার, নুরের নবী চৌধুরি ও সাজেদা খাতুনের নামে নামজারি মামলা নম্বর ৫৭/রাম/৮৯ উল্লেখ করে ৫ দশমিক ০৭ একর ভূমি বিক্রির ভুয়া নোটিং করা হয়। মামলায় কামিনী রঞ্জন ত্রিপুরাসহ সকলকে আসামী করা হয়।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক অফিস সূত্র জানিয়েছে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির তদন্তে ভূমির জাল-জালিয়াতির তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক ছয়টি ভুয়া বন্দোবস্ত মামলা বাতিল করেন। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে রামগড় উপজেলা ভূমি অফিসের  অফিস সহকারী রত্ন বিকাশ ত্রিপুরা, জেলা প্রশাসকের মহাফেজখানা শাখায় অফিস সহকারী ধনরাজ ত্রিপুরা ও সাধনা ত্রিপুরাকে এরই মধ্যে চাকুরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের আরডিসি মঞ্জুরুল আলম এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেন, রামগড় ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম, জেলা কানুনগো দেলোয়ার হোসেন ও রামগড় ভূমি অফিসের চেইনম্যান নুরুল আফসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়ায় ২২৯ নম্বর রামগড় মৌজার হেডম্যান মংসাপ্রু চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফকে চিঠি দেযা হয়েছে।

ইত্তেফাক/এইচএ