দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল গ্রন্থাগার। বছর বছর এই গ্রন্থাগারে সংগ্রহের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অন্যদিকে ক্রমেই গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু করে পড়ার প্রবণতা কমছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের বই ইস্যুর তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্রই দেখা যায়। গত দুই দশকে গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যুর হার কমেছে ৯৬ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া ও ইন্টারনেটে আসক্তিকে বই পাঠ বিমুখতার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা।
বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে শিক্ষার্থীদের বই ইস্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত প্রতি শিক্ষাবর্ষেই প্রায় ৮ লাখ বই ইস্যু হতো। ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে এর পরিমাণ ক্রমেই কমছে। ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে এখন এই পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজারেরও নিচে। ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু হয়েছে ৭৫৭২০০ কপি। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে এর পরিমাণ ছিল ১৯৫৭৫ কপি। আর ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু হয়েছে ২৫১৪৯ কপি। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে এই পরিমাণ মাত্র ৬৩২ কপি। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে ২৯৪ কার্যদিবসে গড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু হয়েছে ২৫৭৫ কপি। বিজ্ঞান শাখায় এর পরিমাণ ৬৬ কপি। আর ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ২৭৭ কার্যদিবসে গড়ে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু হয়েছে ৯০ কপি। বিজ্ঞান শাখায় এর পরিমাণ মাত্র ২ কপি।
বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার (কেন্দ্রীয় ও বিজ্ঞান শাখা) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে ৭৭৬৭৭৫ , ২০০৪-২০০৫ শিক্ষাবর্ষে ৭৮০৬৯০, ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষে ৭৮১৩৪০, ২০০৬-২০০৭ শিক্ষাবর্ষে ৭৮৪৩৪০ , ২০০৭-২০০৮ শিক্ষাবর্ষে ৭৮৩৬৪৮ , ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ৮১৭১০০ , ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে ৮২৫৩২০, ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে ৮২৫৪২০, ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষে ৮১০৭৯০, ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষে ৬০৫৩২০ , ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষে ৫৯০৫০০ , ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে ৪৮৪১০০ , ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ৪৬২২৫০ , ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ৩৭০২০০ , ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৩৩৫১০০ , ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ২৯৭৫৫৯ , ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে ২৭৪৭৬১ , ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ১৮৩৭৩২ এবং ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ২৫৭৮১ কপি বই ইস্যু করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের টেবিলে সারি সারি বই রাখা। সবাই পড়ছেন চাকরির প্রস্তুতির নানা গাইড বই। লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়েন এমন অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জানা যায়-কোচিং সেন্টারের শিট/গাইড পড়ে তারা চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যায় যারা লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করে পড়েন। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিনুর রহমান সবুজ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরে কখনো লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়েননি তিনি । এই চিত্র শুধু সবুজের ক্ষেত্রে না এই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো হাজার হাজার শিক্ষার্থীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার অধ্যাপক ড. মো. নাসিরুদ্দিন মুন্সী বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন সবাই চাকরিমুখী পড়াশোনা করেন। এছাড়া ক্লাসে শিক্ষকরা যা পড়ান তার শিট শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়। যে কারণে তারা লাইব্রেরিমুখী হচ্ছেন কম। শিট পড়েই পরীক্ষায় পাশ করছেন।
এই বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবী জুড়ে এখন জ্ঞানের মূল্য কমে যাচ্ছে। দাপট চলছে টাকার। মানুষের জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ ও স্পৃহা হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বই পড়ার আনন্দ এখন মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটে খুঁজছেন। আবার অনেক সময় ইন্টারনেটে বই ও দেখছেন । বই দেখার ব্যাপার না, পড়ার। যন্ত্রের মধ্যে ঢুকলে এটা আর পড়া থাকে না। বই বলতে আমরা বুঝি বাঁধানো ও ছাপানো জিনিস । এখন এই ধারণা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই ধারণার ওপরেই এখন আঘাত আসছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে বই পাঠ জড়িত। সাংস্কৃতিক জীবণ না থাকলে সেই প্রভাব বই পাঠের ওপর গিয়ে পড়ে। সাংস্কৃতিক জীবনটা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সংস্কৃতির চর্চা আমাদের থেকে উঠে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা যদি বলি—সেখানে কোনো ছাত্র সংসদ নেই। সেখানে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই। গান বাজনা নেই। জ্ঞানের অনুশীলন নেই। মোটকথা সাংস্কৃতিক জীবণটাই আমাদের মধ্যে নেই। এসব কারণেই শিক্ষার্থীরা বইপাঠ বিমুখ হচ্ছেন।’