সংবিধান ও আইনে সবার জন্য সমতাভিত্তিক শিক্ষা, গুণগত ও সমমানের শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭-তে বলা হয়েছে—ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য, খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য, গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সময়ে সময়ে সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালাসমূহ, সাংবিধানিক এ স্বীকৃতি, ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে অনুষ্ঠিত সর্বজনীন বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলন, ১৯৯৫ সালে বেইজিং ঘোষণা এবং ২০০০ সালে সেনেগালের ডাকারে অনুষ্ঠিত সবার জন্য শিক্ষা (EFA) ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যের সঙ্গে অভিন্ন। তখন থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তাদের লোগোতে ‘সবার জন্য শিক্ষা’—স্লোগানটি ব্যবহার করে আসছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গৃহীত পদক্ষেপ বিশেষ করে পিইডিপি-১, পিইডিপি-২ কর্মসূচির মাধ্যমে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাথমিকে ২০১৫-এর মধ্যেই ভর্তি শতভাগ নিশ্চিত করেছে; যা এ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে। শিশুর বয়স ৪-৫ বছর হলেই তাকে কোনো না কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হবে—এ ধারণাটি সরকার আপামর জনসাধারণের মনে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
সবার জন্য শিক্ষা (EFA)-এর ৬টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৬ নম্বরটি ছিল সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ নিয়ে। তাই তো প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে এবারকার আন্দোলন—মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের আন্দোলন। ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জিতব্য জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৪ নম্বর অভীষ্ট তথা SDG-৪-এ বলা হচ্ছে Ensure Incluusive and Equitable Quality Education and Promote Lifelong Learning fo all. যা সরল বাংলায় দাঁড়ায়—সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি। এর ৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৪.১ ও ৪.২ প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক; যা হলো ৪.১ : ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে ও মেয়ে যাতে প্রাসঙ্গিক, কার্যকর ও ফলপ্রসূ অবৈতনিক, সমতাভিত্তিক ও গুণগত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে তা নিশ্চিত করা। ৪.২ : ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে ও মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা।
মন্ত্রণালয়ের রূপকল্পে বর্ণিত আছে—সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষা। এর জন্য অভিলক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে—প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ ও গুণগতমান উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। আর এই অভিলক্ষ্য অর্জনের জন্য ৪টি কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—১. সার্বজনীন, একীভূত ও বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ। ২. মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। ৩. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্প্রসারণ ও নিশ্চিতকরণ। ৪. প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ।
অনেকে বলেন, আমাদের শিক্ষা কখনো আমাদের হয়ে ওঠে না। আমাদের যা শেখানো হয় বেশির ভাগ সময় তা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। শিক্ষার শুরুতে শিক্ষার্থীদের সেই স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি, তারা আসলে কী শিখতে চায়। প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী তার প্রত্যাশা তুলে ধরবে, এটিই প্রত্যাশিত হওয়া উচিত।
সর্বশেষ জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ সালের জন্য সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ১৭.৭.২-এ বর্ণিত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও ১৭.৭.৩-এ বর্ণিত প্রাথমিক শিক্ষার ঝরে পড়া ও অনুপস্থিতি কমানো, শিক্ষায় আরো ভালো সুফল, উত্তম নাগরিক সৃষ্টি এবং পাঠদানের ফলাফল পরিমাপে আরো ভালো পরিমাপের উন্নয়ন বিষয়গুলো সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যেই গৃহীত। আজকের শিশুদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাদের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। আর তাই প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তিত লোগো ‘সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ’।
লেখকঃ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি