যাহারা সত্য জানেন, তাহাদের যদি সত্য বলিবার অবস্থা বা পরিবেশ না থাকে, তাহা হইলে অধিক কথা না বলাই শ্রেয়। তাহারা এই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ গল্প হইতে শিক্ষা লইতে পারেন। এই গল্পে হৈমন্তীর কোনো-এক দিদিমা শাশুড়ি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘নাতবউ, তোমার বয়স কত বলো তো।’ হৈমন্তী বলিল, ‘সতেরো।’ সেইকালে কনের বয়স সতেরো বছর হওয়াটা মানে সেই কনে আইবুড়ো। সেই কারণে অন্যদের নিকট হৈমন্তীর বয়স লুকাইতে তাহার শাশুড়ি বলিলেন, ‘তোমার বাবা যে বলিলেন, তোমার বয়স এগারো!’ হৈম চমকিয়া কহিল, ‘বাবা বলিয়াছেন? কখনো না।’ ইহা লইয়া বিস্তর ঝামেলা হইল। অতঃপর হৈমন্তীর বাবা আসিলে তাহার নিকট প্রশ্ন করিল, ‘কেহ যদি বয়স জিজ্ঞাসা করে কী বলিব?’ হৈমন্তীর বাবা বলিলেন, ‘মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, তুমি বলিয়ো—আমি জানি না...।’
এইখানে হৈমন্তীর ‘বয়স’ হইল ‘নির্বাচন’—যাহা লইয়া সত্য উচ্চারণ করাটা তৃতীয় বিশ্বে সম্ভব নহে। আর সত্য উচ্চারণ করা সম্ভব নহে বিধায় হৈমন্তীর বাবার উপদেশ মতো বলিতে হয়—মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, কথা বরং কম বলা ভালো। যেই সত্য আড়াল করিতে হইবে, সেই প্রসঙ্গে কথা বলাটাই বিপজ্জনক। কারণ, সুরা আল-বাকারায় ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হইয়াছে—‘তোমরা সত্যকে মিথ্যের সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করো না।’ দুঃখের বিষয় হইল, নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রায়শই সত্যের সহিত মিথ্যা মিশ্রিত করা হইতেছে এবং অনেকেই জানিয়া শুনিয়া সত্য গোপন করিতেছেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে দশকের পর দশক ধরিয়া বেশ গালভরা একটি বুলি আওড়ানো হয় যে, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হইবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হইল, নির্বাচনে কত ধরনের সহিংসতা হইতে পারে, তাহার যেন নূতন নূতন দৃষ্টান্ত আমরা দেখিতে পাই। বিশ্বের স্বনামধন্য কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলিতেছে, নির্বাচন কারচুপির মেকানিজমটা উন্নয়নশীল বিশ্বের কিছু দেশ খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছে বহু দশক ধরিয়া। কিছুদিন পূর্বে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি উপজেলায় পৌর নির্বাচনের অনিয়ম লইয়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিস্তর সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল। সেই সকল প্রকাশিত সংবাদে বলা হইয়াছিল, প্রশাসনের নাকের ডগায় সন্ত্রাসীরা গাড়ির বহর লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইলেও নির্বাচন আচরণবিধি বারবার লঙ্ঘন করা হইলেও প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। অথচ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করিবার জন্য সকল পর্যায় হইতে ঘোষণা দেওয়া হইয়াছিল—‘যে কোনো মূল্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা হইবে।’ স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তোলা যায়—এই ধরনের ঘোষণা কি কেবল বাত-কা-বাত?
সুতরাং বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনকে যখন বলা হয়, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ হইয়াছে—তখন উহা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কী? এই চিত্র নূতন নহে—দশকের পর দশক ধরিয়া হইয়া আসিতেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে। এই সকল দেশে কী ধরনের নির্বাচন হয়, তাহা মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না হইলেও যাহারা স্থানীয় পর্যায়ে চোখ-কান খোলা রাখেন, যাহারা ভোটের সহিত যুক্ত কিংবা যাহারা বিভিন্ন দলের কর্মী—তাহারা সকলেই জানেন দশকের পর দশক ধরিয়া কী ধরনের এবং কেমনতর ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ হইয়া আসিতেছে। ইহার সহিত যখন আবেগের আতিশয্যে বলা হয়, অমুকের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, তমুকের জনপ্রিয়তার গভীরতা হার মানাইবে বঙ্গোপসাগরকেও, তখন তাহাদের কথা শুনিয়া ওয়াকিবহাল মহল মুখ টিপিয়া হাসিতে বাধ্য হন। কারণ, এই ধরনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কথা যাহারা বলেন তাহারা কখনো সঠিক ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেন নাই বিধায় মনের মাধুরি মিশাইয়া কল্পবিলাসী কবির মতো নিজের লিডারকে অস্বাভাবিক বিশেষণে ভূষিত করিতে লজ্জা পান না।
অতএব এই সকল দেশে সঠিক নির্বাচনের কথা বলা উচিত নহে। এই বিষয়ে কথা না বলাই উত্তম। অবস্থা এমন হইয়াছে যে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’ কথা শুনিলেই অনেকের মনে ঢাকাইয়া কুট্টিদের কথাটি গুঞ্জরিত হয়—‘আস্তে কন হুজুর, হুনলে ঘোড়ায় ভি হাসব!’ যেই কথা শুনিয়া ঘোড়াও হাসিবে, সেই কথা বলিবার দরকার কী?