জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। এমন কোনো দেশ নেই, যেখানকার মানুষ আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের শিকারে পরিণত হচ্ছে না। এর ফলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি তো হচ্ছেই, পরিবেশের ওপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। প্রতি বছর প্রাণহানিও ঘটছে ব্যাপক হারে। অর্থাত্, জলবায়ু পরিবর্তন ‘গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠছে দিনকে দিন। নিউ ইয়র্কের দুর্যোগ এর জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে নিউ ইয়র্ক। শক্তিশালী ঝড়ের প্রভাবে অতিবৃষ্টি এবং তা থেকে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নিউ ইয়র্ক শহর পড়েছে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে। জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। শহরের কয়েকটি সাবওয়ে সিস্টেম, রাস্তা ও হাইওয়ে চলে গেছে পানির নিচে। যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বিভাগের (ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস) তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) আকস্মিক বন্যার কারণে শহরের বেশ কিছু এলাকা ডুবে যায়। ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত পানির নিচে হাবুডুবু খায় এলাকাগুলো। বিভিন্ন সাইটে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, সাবওয়ে স্টেশন ভাসছে বৃষ্টির পানিতে। যানবাহনকে গ্রাস করছে বানের পানি। শহরের চৌরাস্তাগুলো যেন পরিণত হয়েছে হ্রদে। শুধু নিউ ইয়র্ক শহর নয়, আশপাশের বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে ভারী বর্ষণে।
শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এ মাসে নিউ ইয়র্ক শহরে আনুমানিক ১৪ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে, ১৮৮২ সালের পর যা রেকর্ড! ভারী বর্ষণের ফলে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় দুই ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। শহরের সেন্ট্রাল পার্কে পাঁচ ইঞ্চির বেশি এবং জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আট ইঞ্চির বেশি পানি জমে যায়। জানা যাচ্ছে, দৈনিক হিসাবের ভিত্তিতে এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত ‘রেকর্ড’।
বলা বাহুল্য, ভারী বৃষ্টিপাত নিউ ইয়র্কের জন্য কী পরিমাণ দুর্ভোগ-দুর্দশা বয়ে আনতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল চলমান বন্যা। এবারের বন্যা নিউ ইয়র্কবাসীকে দুই বছর আগেকার মারাত্মক বন্যার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। হারিকেন ইডার প্রভাবে বছর দুই আগে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে নিউ ইয়র্ক শহর। যা হোক, বন্যাকবলিত নিউ ইয়র্ক শহর তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কতটা প্রলয়ংকরী হয়ে উঠছে, তা নিয়ে দু-চার কথা বলা জরুরি মনে করছি।
নিউ ইয়র্ক সিটির ইতিহাসে বন্যার তাণ্ডবলীলা নতুন কিছু নয়। তবে আগেকার ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এবারের ঘটনার খানিকটা বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এবারকার বন্যা যেরূপ মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে নিউ ইয়র্কবাসীর জন্য, তেমনটা দেখা যায়নি আগে কখনো! এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, বিপর্যয়ের মাত্রা কতটা প্রকট হতে পারে। এ কথা বলার কারণ, এই লেখা পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত অবিরতভাবে আছড়ে পড়ছে নিউ ইয়র্কবাসীর মাথার ওপর।
নিউ ইয়র্ক শহরের যাতায়াত সেবা প্রদানকারী সংস্থা মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন এজেন্সি জানিয়েছে, পানি উঠে যাওয়ায় কয়েকটি সাবওয়ে লাইনে চলাচল পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় অনেক স্টেশন। শহরের উত্তরাঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ঐ অঞ্চলে উদ্ধারকর্মীরা বাতাস দিয়ে ফুলানো নৌকা ব্যবহার করে আটকে পড়া বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন। ঘটনাস্থলের ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, তুমুল বর্ষণের মধ্যে হাঁটুপানিতে হাঁটছে মানুষ জন। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করা অনেক ভিডিওতে দেখা যায়, সাবওয়ে স্টেশনের দেওয়াল ও ছাদ থেকে পানি চুয়ে পড়ছে। এসব দৃশ্য হূদয়বিদারক বইকি।
এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নিউ ইয়র্কের জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা রোহিত আগারওয়াল জানান, শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ঘণ্টায় ১ দশমিক ৭৫ ইঞ্চির বেশি বৃষ্টি সামাল দিতে পারে না। অথচ ব্রকলিন নেভি ইয়ার্ড থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, মাত্র এক ঘণ্টায়ই ২ দশমিক ৫ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এ থেকে সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল, বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে চলেছে সংশ্লিষ্ট এলাকা।
স্মরণে থাকার কথা, হারিকেন ইডার প্রভাবে তীব্র বন্যা সংঘটিত হয় ২০২১ সালে। যদিও তার সঙ্গে এবারের বন্যাকে মেলানোটা ঠিক হবে না। ঐ বন্যার সময় প্রথম দিকে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের হার ছিল ঘণ্টায় প্রায় তিন ইঞ্চি। এরপর বৃষ্টি বাড়তে শুরু করলে ৭ দশমিক ১৩ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। দেখা যাচ্ছে, এবারের বৃষ্টিপাত ইডা-বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে। কারণ, আকস্মিক ঝড়ের পর এবার যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো! রেকর্ড ৮ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে নিউ ইয়র্ক শহরে—যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। সত্যি বলতে, এমন বিপর্যয়কর ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড (আকস্মিক তীব্র বন্যা)’ আগে দেখিনি আমরা।
জাতীয় আবহাওয়া পরিষেবা অফিসের আবহাওয়াবিদ ডমিনিক রামুন্নি বলেছেন, নিউ ইয়র্ক শহরে যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে ইডার চেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, ১৯৪৮ সাল থেকে যখন বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা শুরু হয়, সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। অর্থাত্, নিউ ইয়র্কবাসীর জন্য এ বন্যা কতটা ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় বয়ে এনেছে, তা সহজে অনুমেয়।
সবার জানা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। এমন কোনো দেশ নেই, যেখানকার মানুষ আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের শিকারে পরিণত হচ্ছে না। এর ফলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি তো হচ্ছেই, পরিবেশের ওপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। প্রতি বছর প্রাণহানিও ঘটছে ব্যাপক হারে। অর্থাত্ জলবায়ু পরিবর্তন ‘গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠছে দিনকে দিন। নিউ ইয়র্কের দুর্যোগ এর জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত।
নিউ ইয়র্কের দুর্যোগ যান্ত্রিক বা বৈজ্ঞানিক ত্রুটির কারণে সংঘটিত হলো কিনা তা জানতে কমবেশি অধ্যয়নের প্রয়োজন পড়বে; কিন্তু এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন যে অনেক বেশি দায়ী, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, তা মানবসভ্যতার টিকে থাকার জন্য বড় ধরনের হুমকিস্বরূপ। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়, যার ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র বন্যা। এ রকম বহু জরিপ পরিচালিত হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে—বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অতিবৃষ্টির ফলে তীব্র বন্যা, বন্যা বা বন্যা-পরিস্থিতি দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং তা থেকে অতিবৃষ্টি ও বন্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাবে আগামী দিনগুলোতে। সাগর-মহাসাগর, হ্রদ থেকে বাষ্পীভবনের হার বাড়বে। ফলস্বরূপ, ঘূর্ণিঝড় ও আকস্মিক বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের করাল গ্রাসের শিকার হবে বিশ্ববাসী।
এ অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে, বন্যার হাত থেকে বাঁচতে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি আমরা? প্রথমেই বলতে হয়, এক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি সরকারি পরিষেবা জোরদারে মনোনিবেশ করতে হবে। বন্যার ক্ষেত্রে আবহাওয়াবিদেরা সব সময় সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এই কথা বলে, যে সব স্থান বন্যার পানিতে ডুবে যায়, তা এড়িয়ে চলতে হবে যথাসম্ভব। এ ধরনের সস্তা কথা তো সবারই জানা।
এবারের দুর্যোগের পর নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ক্যাথি হচুল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (যা আগে টুইটার হিসেবে পরিচিত ছিল) পোস্ট করেছেন, ‘এই ঝড় ও আকস্মিক বন্যা অত্যন্ত ভয়াবহ। জনজীবনের জন্য এটা যে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’ কবলিত এলাকার বাসিন্দাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তায় কখনোই যাতায়াত করবেন না।’ গভর্নরের উচ্চারণ ওপরে বর্ণিত কথার মতোই, যাকে ‘সস্তা’ কথা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় সবসময়ই। কিন্তু এও মনে রাখা জরুরি, দুর্যোগে কারো হাত নেই। এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে, ‘সাবধানের মার নেই।’
লেখক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় বিজ্ঞান ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সহযোগী সম্পাদক
সায়েন্টিফিক আমেরিকান থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন