রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ :অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত

আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৩০

বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্রমশ বিকাশমান ও শক্তিশালী হচ্ছে। সৌদি আরবের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশি জনগণের আন্তরিক, সৌহার্দপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতি বছর ১ লাখ ২৭ হাজার হজযাত্রী হজ করেন এবং প্রায় ৪ লাখ ওমরাহ পালন করেন। প্রায় ২৮ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন, যাদের বাংলাদেশে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে, দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে সম্পর্ক শুধু হজ ও ওমরাহ এবং সৌদিতে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সৌদি আরব এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের ভূমিকা অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। সৌদি আরব মুসলিম ও আরব বিশ্বের নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে দেশটির ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের ভিত আরো মজবুত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সৌদি আরবের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চার বার রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরবে গেছেন। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদ ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ফলপ্রসূ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন, যার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতার দিকে ধাবিত হয়। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে সৌদি আরবের চার জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। ফলে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের গতি বাড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত সৌদি বিনিয়োগের ফলে বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সৌদি আরব তেলসমৃদ্ধ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। সৌদি ধনকুবেরদের যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বহু বিনিয়োগ আছে। বর্তমানে বাংলাদেশের দিকে সৌদি বিনিয়োগকারীগণ ধাবিত হওয়ায় বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী দেশের তালিকায় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ সৌদি আরব যুক্ত হলো।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে সৌদি ট্রান্সপোর্ট ও লজিস্টিক সার্ভিস মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার সালেহ আল জাশের বাংলাদেশ সফর করেন এবং সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Special Economic Zone) ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ জোন প্রতিষ্ঠার চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জমি বরাদ্দ করা হয় চট্টগ্রামে। এই বিশেষ শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে বাংলাদেশের বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং এখানে উত্পাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। সৌদি আরবের বিপুলসংখ্যক বড় বিনিয়োগকারী বিশ্বের অনেক দেশে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। সৌদি আরবের জন্য বাংলাদেশে নির্ধারিত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করতে শুরু করবেন। বাংলাদেশে যেহেতু কম পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাওয়া যায়, তাই সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।

সৌদি মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল আল ফাহাদ ২০২২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেন এবং বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের উন্নয়নে সৌদি আরবের সহযোগিতা ও বিনিয়োগ আরো বাড়বে বলে প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করেন। সৌদি আরবের বাণিজ্যমন্ত্রী মাজেদ বিন আবদুল্লাহ আল কাশাব ২০২৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। তার সফরের সময় তিনি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এছাড়া সৌদি আরবের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. নাসের আদ দাউদ ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। ২০২৩ সালের আগস্টে, সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী ড. তৌফিক বিন ফাওজান আল-রাবিয়াহ অন্য একজন মন্ত্রী এবং তিন জন উপমন্ত্রীসহ ১৬১ জন সফরসঙ্গীসহ বাংলাদেশ সফর করেন। সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের মধ্যে সৌদি পরিবহন ও লজিস্টিক সার্ভিস মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী এবং সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রীর সফর থেকে বোঝা যায় যে দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার পারদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের প্রায় ২৮ লাখ প্রবাসী সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্র দেশের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স সৌদি আরব থেকেই সর্বোচ্চ পরিমাণে আসে।

হজযাত্রীদের সৌদি আরবের ইমিগ্রেশন ঢাকায় সম্পন্ন হচ্ছে, এতে লাখ লাখ হজযাত্রী সৌদি আরবের জেদ্দা বা মদিনা এয়ারপোর্টে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিড়ম্বনা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন। এমনকি তাদের ব্যাগেজও ঢাকার আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে সৌদি আরবের মক্কা-মদিনার হোটেলে পৌঁছে দেয়। এতে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের বহু বিড়ম্বনা লাঘব হয়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক হজযাত্রীগণ বিমানবন্দরে ব্যাগ হ্যান্ডলিং ও হোটেলে যেতে কষ্ট করে ব্যাগ বহন করতে হয় না।

বাংলাদেশি মুসলমানদের আজন্ম লালিত স্বপ্ন হজ ও ওমরাহ পালন এবং ২৮ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসীর কর্মস্থলের গন্তব্য হওয়া ছাড়াও সৌদি আরব এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। এদিকে সৌদি আরবের বিখ্যাত পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, ‘অ্যাকোয়া পাওয়ার’ বিদ্যুত্ খাতে ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সৌদি অ্যাকোয়া পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ৭৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন ক্ষমতার প্লান্টের নির্মাণকাজ শুরু করেছে। এছাড়া ১ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সৌহার্দপূর্ণ। এই সম্পর্ক ক্রমশ দৃঢ় হতে থাকায় পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগও সীমাহীন হয়ে পড়েছে। সৌদি আরবের অনেক বিখ্যাত ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে। ভবিষ্যতে দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সম্পর্ক আর্থিক সহযোগিতায় দৃঢ় এবং বৃহত্ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হবে। উভয় ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ একে অপরকে যথাযথ সম্মান, গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনা করে।

বাংলাদেশে সৌদি আরবের বর্তমান মান্যবর রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ ঈসা আলদুহাইলান রাষ্ট্রদূত হয়ে বাংলাদেশে  আগমনের পর থেকেই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের সম্পর্কের আরো উন্নয়ন ও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর এবং বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। সৌদি আরব একটি আধুনিক আরবি ভাষা ও সংস্কৃত ইনিস্টিটিউট স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। সৌদি অর্থায়নেই এই ইনিস্টিটিউট ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যার মাধ্যমে আমাদের সৌদিগামী চাকরিপ্রার্থীগণ আরবি ভাষা এবং সৌদি সাংস্কৃতিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ পাবেন। বর্তমানে আমাদের বেশির ভাগ প্রবাসী শ্রমিক কাজের কোনোরূপ পূর্ব অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ও ভাষাজ্ঞান ছাড়া সৌদি আরব গমন করেন এবং কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। সৌদি আরবের অর্থায়নে স্পেশালাইজড আরবি ভাষা শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপিত হলে সৌদি আরবে গমন করে আমাদের প্রবাসীগণ আরো বেশি অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবেন এবং আমাদের দেশ উপকৃত হবে।

তাছাড়া সৌদি আরব বড় বড় নতুন অর্থনৈতিক জোন ও বিশেষ সিটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে ভবিষ্যতে আরো বহু বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌদি আরবের জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের সব জনগণের পক্ষ থেকে ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি জনগণ ও সরকারকে উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আশা করি ভবিষ্যতে দুই দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগ করে লাভবান হবেন এবং এতে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। দুই দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক পারস্পরিক উন্নয়ন ও অংশিদারিত্বের সম্পর্কের ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করছে।

লেখক: সভাপতি, হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন