উন্নয়নশীল দেশগুলিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কেন অরণ্যে রোদন, তাহা আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না। এই সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার পশ্চাতে আমরা একতরফাভাবে রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করিয়া চলিয়াছি। এই ক্ষেত্রে তাহাদের কোনো দোষ নাই, এমন কথা আমরা বলি না। এই জন্য রাজনীতিবিদদের বদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলা হইতেছে; কিন্তু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে কি রাজনীতিবিদরাই একমাত্র প্রতিবন্ধক? ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন একটি বিপুল কর্মযজ্ঞ। ৪২ হাজার ১০৩টি ভোটকেন্দ্রের জন্য ৫২ হাজার ৬২৮ জন প্রিজাইডিং অফিসারের পাশাপাশি দুই লক্ষাধিক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পাঁচ লক্ষাধিক পোলিং অফিসার এইবার দায়িত্ব পালন করিবেন দেশের জাতীয় নির্বাচনে। ইহাতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনিক, শিক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকর্তার ভূমিকা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নহে; কিন্তু তাহারাই যখন সততা ও নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হইতে পারেন না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থের নিকট বিক্রয় হইয়া যান, তখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে আশা করা যায়?
যাহারা রাজনৈতিক কর্মী এবং মাঠে-ময়দানে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করিয়া থাকেন তাহাদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নহে। বিশেষ করিয়া, যাহারা নির্বাচন আয়োজনের সহিত সম্পৃক্ত, তাহারা স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা অনেক সময় পাতি নেতাদেরও হুকুমমতো চলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মেরও ঘটনা ঘটিয়া থাকে। এই আর্থিক বিবেচনার কারণে তাহাদের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসম্ভব। যেইখানে নির্বাচন কমিশন এই সকল নেতার কথামতো সংসদীয় আসনের সীমানা পর্যন্ত বদলাইয়া ফেলিতে পারেন, সেইখানে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কীভাবে সম্ভব? নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা রহিয়াছে। অনেকে মনে করেন, কমিশনের এই নিজস্ব ক্ষমতা দেশের প্রচলিত আইনের সহিত সাংঘর্ষিক। এইখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার অনেক সময় স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকরাও হইয়া থাকেন। একদিকে নির্দিষ্ট করিয়া কোনো কোনো দলকে ঠেকানোর কথা বলা হইতেছে, অন্যদিকে তাহাদের মতাদর্শীরাও যখন নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করিতেছেন, তখন তাহা কি বৈসাদৃশ্য নহে? ইহা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। সেই হিসাবে নির্বাচনের বাকি রহিয়াছে আর মাত্র তিন মাস; কিন্তু বিরোধী নেতাকর্মীদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার শুরু হইয়াছে, যাহাতে তাহারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনই করিতে না পারেন। স্থানীয় পাতি নেতাদের কথামতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগ যদি এইভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে, তাহা হইলে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে সম্ভব?
সম্প্রতি দক্ষিণাঞ্চলের একটি পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া মিথ্যা, সাজানো ও ভিত্তিহীন মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর দলের শীর্ষস্থানীয় ১০ জন নেতাকে গ্রেফতার করিয়া যেইভাবে নির্বাচন পর্যন্ত আটকাইয়া রাখা হইয়াছে তাহাতে একটি ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত তৈরি হইয়াছে। এইখানে নির্বাচনের রাত্রে কালোটাকার ছড়াছড়ি প্রত্যক্ষ করা গেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তত্ক্ষণাত্ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। দেশের অন্যত্রও এই সকল অপকর্ম কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় নেতাদের অজ্ঞাতে হয়তো সংঘটিত হইতেছে; কিন্তু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারপ্রধানের অঙ্গীকার বিষয়ে তৃণমূলে যতক্ষণ পর্যন্ত কঠোর বার্তা না দেওয়া হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ে পাতি নেতাদের আস্ফাালন ও বাড়াবাড়ি বন্ধ হইবে না। আমাদের প্রশ্ন, কেহ বিরোধী দল বা নিজ দলের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হইলেই তাহাকে কেন গ্রেফতার করিতে হইবে? অবশ্য ইতিপূর্বে এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও যে এমন ঘটনা ঘটে নাই তাহা নহে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে ইহা অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক।
আমরা মনে করি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। কাহাকেও দেশছাড়া করা বা মামলা-মোকদ্দমা দিয়া বন্দি রাখিলে তাহাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা তৈরি হইবে না। আবার যতক্ষণ না জনগণ তাহাদের ভোটের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন না হইবেন এবং শিক্ষাদীক্ষা ও আর্থিকভাবে সচ্ছল না হইবেন, ততদিন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করাও কঠিন। আমাদের সমাজ এখনো আধাসামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ইহাও যে বড় একটি বাধা—তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।