শাটডাউন বা অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মুখে পড়ার হাত থেকে শেষ পর্যন্ত সাময়িক রক্ষা পেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় শনিবারের পর (১ অক্টোবর মধ্যরাত) শাটডাউন শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে শাটডাউন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে দ্বিদলীয় বিল পাশ করে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ, যার ফলে স্বল্পমেয়াদি তহবিল চুক্তিতে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে অল্পের জন্য শাটডাউন এড়াতে সক্ষম হয় বাইডেন সরকার। বলে রাখা দরকার, উক্ত বিল পাশ না হলে বন্ধ হয়ে যেতে পারত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এবং সার্বিক ফলাফলে সংকটাবস্থায় পড়ত যুক্তরাষ্ট্র। অচল হয়ে পড়ত যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এমনকি বন্ধ হয়ে যেতে পারত শিশুদের পুষ্টি প্রোগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও। অর্থাত্, শাটডাউন হয়ে উঠত বিপদের বড় কারণ।
যে শাটডাউন নিয়ে এত কথা, চলুন দেখে আসা যাক সেই শাটডাউন ঠিক কী এবং এর বিরূপ প্রভাবই-বা কতটা তীব্র।
শাটডাউন কী : সরকারি ব্যয় মেটাতে নতুন অর্থবছরের জন্য তহবিল অনুমোদন দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদের উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ কংগ্রেস। ১ অক্টোবর থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হওয়ার সময় বরাদ্দ করা হয় এ অর্থ-তহবিল। এক্ষেত্রে অনেক সময় বিরোধী দলের দাবি বা চাপের মুখে অর্থ বরাদ্দ আটকে যায়। এর ফলে স্বভাবতই সংকটের মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একে ‘গভর্নমেন্ট শাটডাউন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যেমন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণে থাকা কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি আটকে রেখেছিল এবার। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির কাছে তারা সরকারি ব্যয় কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। এ অবস্থায় শাটডাউনের শঙ্কায় সংকটের মুখে পড়ার উপক্রম হয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। উল্লেখ্য, স্বল্পমেয়াদি তহবিল বিল পাশের মাধ্যমে শাটডাউন এড়ানো যেতে পারে, যেমনটি ৩০ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের ঠিক আগে ঘটতে দেখা গেছে।
শাটডাউন শুরুর ফলে কী ঘটত :যদি আইনপ্রণেতারা স্বল্পমেয়াদি তহবিল চুক্তি তথা বরাদ্দ বিল প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হতেন, তবে শাটডাউন শুরু হওয়ার ফলে স্থগিত হয়ে যেত সিংহভাগ সরকারি কার্যক্রম। এর ফলে সম্পূর্ণ বা আংশিক গুটিয়ে যেত সরকার। যদিও চালু থাকত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বা অতি প্রয়োজনীয় সরকারি কাজকর্ম।
শাটডাউনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন নয়। তাই শাটডাউনের মুখে পড়ার উপক্রম হলে ফেডারেল এজেন্সিগুলো ‘তত্ক্ষণাত্ পরিকল্পনা’ গ্রহণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শাটডাউনের সময় কোন কাজগুলো চলবে এবং কোনগুলো বন্ধ হবে—স্বল্প সময়ের মধ্যেই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় ফেডারেল এজেন্সিকে। পাশাপাশি কতজন কর্মচারী দিয়ে কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া যাবে এবং শাটডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কত জনকে ছুটি দেওয়া হবে, তার রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয় অনেকটা তড়িঘড়ি করে! অর্থাত্, শাটডাউনের শুরুর ফলে বেকায়দায় পড়ে যেত বাইডেন প্রশাসন তথা ডেমোক্রেটিক পার্টি।
দৈনন্দিন জীবনে শাটডাউনের প্রভাব কী : শাটডাউন শুরু হলে বহু ফেডারেল কর্মীর চাকরি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ বা ধীর হয়ে যায় সরকারি পরিষেবা কার্যক্রম। এর ফলে প্রাত্যাহিক জীবনে কী ঘটতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। শাটডাউনের মুখে মার্কিন নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে, যা তাদের জন্য অত্যন্ত বিরক্তিকর স্বভাবতই। যদিও ছাড় থাকে কিছু ক্ষেত্রে। বয়স্ক, প্রতিবন্ধীসহ কিছু ক্যাটাগরির নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম (সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাকটিভিটিজ) চালু থাকে। নিয়মিত পরিষেবা চালিয়ে যায় ডাক পরিষেবার মতো কিছু বিশেষ খাত। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো নির্দিষ্ট কিছু উদ্যান খোলা রাখার বন্দোবস্তও করা হয় নিজস্ব অর্থ তহবিল ব্যবহার করে। যাহোক, ব্যক্তিজীবনে কোনো সাধারণ নাগরিকই শাটডাউনের মুখে পড়তে চাইবেন না, এ কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়।
সরকারি কর্মীদের ওপর শাটডাউনের প্রভাব কতটা :যখন শাটডাউন নেমে আসে, তখন এর অভিঘাতে লাখ লাখ ফেডারেল কর্মচারী ছিটকে পড়েন কাজের বাইরে। সামরিক পরিষেবা সদস্যরা বেতন পান না শাটডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। যেমনটা বলা হয়েছে আগে—কেবল জননিরাপত্তা বা জাতীয় নিরাপত্তা খাতে নিয়োজিত কর্মচারীরা কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
যাহোক, কাজ হারানোর ফলে সরকারি কর্মচারীরা নিপতিত হন চরম বাজে অবস্থায়। সঞ্চিত অর্থে হাত দিতে বাধ্য হন অনেকে কিংবা অর্থ উপার্জনে খুঁজতে হয় নতুন কাজ। যে যেভাবে পারেন, অর্থ আয়ের উপায় খুঁজে বের করতে চেষ্টা চালান। এভাবে চলতে থাকে শাটডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
এবারের শাটডাউন এড়ানো না গেলে ৪০ লাখ কেন্দ্রীয় কর্মীর বেতন-ভাতা পরিশোধ বন্ধ হয়ে যেত। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেত আর্থিক খাতের নজরদারি থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার তহবিল।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে তথা শেষ শাটডাউনের সময় আনুমানিক ৪ লাখ ২০ হাজার ফেডারেল কর্মচারী বেতন ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঐ সময় ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছিলেন ৩ লাখ ৮০ হাজার কর্মী।
অর্থনীতির ওপর শাটডাউন কী ধরনের প্রভাব ফেলে :যদি পূর্ণ শাটডাউনের কবলে পড়ে সরকার, তবে তা তীব্র অর্থনৈতিক অচলাবস্থার অবতারণা করে—সহজ হিসাব এটাই। এর ফলে দেখা দিতে পারে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট। তাছাড়া শাটডাউন শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই বাধাগ্রস্ত করে না, রাষ্ট্রীয় আর্থিক খাতকে ফেলে দেয় তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্যে।
এক হিসাব অনুসারে, এবার যদি শাটডাউনের শিকার হতো যুক্তরাষ্ট্র, তাহলে মার্কিন অর্থনীতি প্রতি সপ্তাহে ৬ বিলিয়ন হারে ক্ষতির সম্মুখীন হতো। এর ফলে ২০২৩ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধি শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পেত। অর্থাত্, শাটডাউন মার্কিন অর্থনীতির জন্য কতটা ভয়াবহ, তা আর বুঝতে না পারার কথা নয়।
শাটডাউন এড়ানোর পর কী ঘটবে : মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ স্বল্পমেয়াদি তহবিল চুক্তিতে সম্মত হওয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বিলের মাধ্যমে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরকারকে অর্থায়ন করা যাবে। প্রতিনিধি পরিষদে ৩৩৫-৯১ ভোটে অনুমোদিত হয় এই বিল। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিনিধি পরিষদে অনুমোদিত বিল এখন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের চেম্বারেও অনুমোদিত হতে হবে। এ বিল যে সেখানে সহজেই পাশ হবে, আশা করা হচ্ছে এমনটাই। আর এরপর বিলে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে আইনে পরিণত করতে পারলে তা মার্কিন সরকারের ফেডারেল পরিষেবাগুলোতে সম্ভাব্য ব্যাঘাত এড়াতে সহায়তা করবে।
এদিকে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা শাটডাউন এড়ানোকে ‘বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। জানা যাচ্ছে, প্রায় ২০৯ জন ডেমোক্র্যাট এই বিলকে সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে এই বিল সমর্থনকারী রিপাবলিকানের সংখ্যা ১২৬ জন। উল্লেখ করার বিষয়, বিল পাশ হওয়ায় নিজের দলের কট্টরপন্থিদের কাছ থেকে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছেন রিপাবলিকান হাউজ সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা কেভিন ম্যাকার্থি। এ-ও উল্লেখ করা দরকার, আপাতত শাটডাউন এড়ানো গেলেও অনেক রিপাবলিকানের দাবি, সরকারি ব্যয় কমাতে হবে অনেকখানি। এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনকে সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার দাবিও করছেন তারা।
শোনা গেছে, রিপাবলিকানদের এখন সিনেটের প্রস্তাবই মেনে নিতে হবে, তা না হলে সরকার অচল হয়ে পড়ার দায় এসে পড়বে তাদের ঘাড়ে! যদিও রিপাবলিকান শিবিরের বিদ্রোহী সদস্যরা এমন দাবিতে অনড় রয়েছেন, ‘পূর্ণকালীন বিল ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে রাজি হব না আমরা।’
লেখকদ্বয় :সিএনএনের নিয়মিত কলামিস্ট
সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন