শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

‘বৈশ্বিক রূপ’ নিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ!

আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৩০

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে। ধারণা করা হয়েছিল, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিয়েভে সরকার পরিবর্তন চান। একই সঙ্গে রাশিয়া পুরো অথবা আংশিক ইউক্রেন দখল করে নিবে। ইউক্রেনের অংশবিশেষ অবশ্য রাশিয়ার দখলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে এই যুদ্ধের লক্ষ্য আরো সুদূরপ্রসারী। পুতিন চান পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন একমেরু ভেঙে বহু মেরুকেন্দ্রিক নয়া বিশ্বব্যবস্থা। রাশিয়া হবে যার একটি মেরু।

তবে পুতিন যুদ্ধে কম বাধার মুখে পড়েননি। এই যুদ্ধে তিনি এখনো আপারহ্যান্ডে আছেন। পশ্চিমা প্রাধান্য খর্ব করার বাসনা তার দীর্ঘ দিনের। ২০০৭ সালে মিউনিখ শান্তি সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন যে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তার দেশ দিনদিন গুরুত্ব হারাচ্ছে। রাশিয়াকে তিনি একটি নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ সবকিছু যেন একই সূত্রে গাঁথা। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে তিনি দেখাচ্ছেন যে, পশ্চিমারা আসলে রাশিয়ার মোকাবিলায় দুর্বল। এটি দেশের ভেতরেও তার রাজনৈতিক ভিত মজবুত করেছে।

রাশিয়া এই যুদ্ধকে একটি বৈশ্বিক রূপ দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে মস্কো নিরপেক্ষ দেশগুলোকে নিজস্ব সরবরাহ লাইনে এনেছে। পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল নয়, এমন দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করেছে। আদর্শিকভাবে রাশিয়া পশ্চিমকে অনির্ভরযোগ্য মিত্র প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছে। বুুঝিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো যতই ইউক্রেনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিক সেটা চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। কূটনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়া এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নিয়ে গেছে। তা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদই হোক অথবা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। সবখানে ইউক্রেন ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে। পুতিন যুদ্ধ দীর্ঘ করে বিভিন্ন দেশের হতাশা বাড়িয়েছেন। মস্কো চাইছে দেশগুলো রাশিয়া সমর্থন না করুক নিরপেক্ষ থাকুক।

এই যুদ্ধ কেন্দ্র করে রাশিয়া পরমাণুভীতি ভালোভাবেই ছড়িয়েছে। গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে ইউরোপকে জ্বালানি সংকটে ফেলার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে পরমাণু ভীতি সঞ্চার করেছে। প্রমাণ করেছে জ্বালানি ও খাদ্যশস্য রুট আসলে রাশিয়াই নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে দেশটি পরমাণু শক্তিও ব্যবহার করতে পারে। রাশিয়া শেষ পর্যন্ত তুরস্কের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগরের মধ্য দিয়ে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ যেতে দিতে রাজি হয়েছে। যদিও পরমাণু শক্তি ব্যবহারের ঝুঁকি এখনো তৈরি হয় নাই, কিন্তু পুতিন বিভিন্ন সময়ে বলেছেন পরমাণু শক্তি ব্যবহারের সম্ভবনা তিনি একেবারে নাকচ করছেন না। পুতিনকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের এই যুদ্ধকে বৈশ্বিক আঙ্গিকে দেখতে হবে। কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়েই ক্রেমলিনকে কাবু করা সম্ভব নয়।

সোভিয়েত আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রভাবগুলো পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করবেন পুতিন। সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই রাশিয়া ইউরোপীয় ব্যবস্থার অংশ। উনবিংশ শতাব্দী থেকেই পশ্চিমে সীমান্ত প্রসারিত করেছে দেশটি। সাম্রাজ্যবাদী অতীতের স্বাক্ষর রেখেছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাতেও। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি নিকিতা ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দিকে নজর দেন। ৯০-এর দশকে বরিস ইয়েলেসিন ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইয়েলেসিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন পশ্চিমাপন্থি আঁদ্রে কোজিরেভ। ইয়েলেসিনকে তিনি বহুমেরু বিশ্বের ধারণার থেকে অনেকটা বের করে আনেন। কোজিরেভের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন ইয়েভগেনি প্রিমাকভ। তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়া আবার ফিরে আসুক। ঐ সময় ইয়েলেিসনের ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের ডিরেক্টর ছিলেন পুতিন, পরে তিনি ফার্স্ট ডেপুটি হন। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। পুতিন ছিলেন প্রিমাকভের ভাবশিষ্য, যদিও পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ঘটে। পুতিন ক্ষমতায় আসার পর প্রথম এক দশকের বেশি সময় রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল। এ কারণে রুশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ও সোভিয়েত যুগের সফট পাওয়ারগুলো পুনরুদ্ধার করা পুতিন প্রশাসনের জন্য সহজ হয়। অনেকে মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। বিষয়টি আসলে তা নয়, এটি বরং রাশিয়ার নয়া বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষকে শানিত করেছে।

এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ইমেজ কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করেছে। তবে এই যুদ্ধ রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি। বরং বিশ্বমঞ্চে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপন করেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। পুতিন দেখাতে চাইছেন যে, তিনিই একালের ডেভিড আর পশ্চিম হলো গোয়লিয়থ। পশ্চিমের রাশ টেনে ধরার ক্ষমতা একমাত্র তার দেশেরই আছে।

ইত্তেফাক/এএইচপি