বাঘায় মোগল নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নারী মসজিদ। প্রায় ৩০০ বছরের পুরানো এ মসজিদের স্থাপত্যরীতিতে মোগল ভাবধারার ছাপও সুস্পষ্ট। মসজিদের ভেতরে প্রবেশপথের মূল দরজার ওপরে ফারসি ভাষায় পাথরে খচিত শিলালিপি নিয়ে রয়েছে লোমহর্ষক ঘটনা।
মসজিদটি বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। পুনরায় সংস্কার করে মসজিদটি চালুর দাবি এলাকাবাসীর। রাজশাহী শহর থেকে ৪৯ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে বাঘা উপজেলা সদরে হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলার (রহ.) পুত্র হজরত শাহ আউল হামিদ দানিশ মন্দ (রহ.) মাজার সংলগ্ন এলাকায় এ মসজিদ অবস্থিত। পাশেই রয়েছে হজরত জহর শাহর (রহ.) মাজার। মসজিদ দেখতে বছরজুড়ে এখানে আসেন পর্যটক ও দর্শনার্থীরা।
তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা বা ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এ স্থাপনা সংরক্ষণে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের অবস্থান প্রায় ৩০ ফুট সুউচ্চ টিলার ওপর। বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য ২৭ ফুট, প্রস্থ ১৩ ফুট। চারপাশের দেয়াল ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া। উত্তর ও দক্ষিণে লম্বাকৃতির মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। মসজিদের ইট ধূসর বর্ণের। এ ইটের দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি, প্রস্থ ৬ ইঞ্চি এবং চওড়া দেড় ইঞ্চি। বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি একেবারেই আলাদা। দর্শনার্থী ও নামাজিদের ওঠা-নামার জন্য মসজিদের পূর্ব দিকে রয়েছে প্রবেশপথ। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, প্রায় ৫০০ বছর আগে পাঁচজন সঙ্গীসহ সুদূর বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য বাঘায় এসেছিলেন হজরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রহ.)। তিনি বসবাস শুরু করেন পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে।
আধ্যাত্নিক শক্তির বলে এ এলাকার জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন তিনি। এ সময় শাহদৌলার অনেক অলৌকিক কীর্তি দেখে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী তার কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের দেয়া তথ্য মতে, হজরত শাহদৌলার (রহ.) পুত্র হজরত শাহ আবদুল হামিদ দানিশ মন্দর (রহ.) মৃত্যুর পর তার তৃতীয় পুত্র মাওলানা শাহ আবদুল ওয়াহাব (রহ.) বাঘার খানকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ওই সময় দিল্লির সম্রাট শাজাহানের প্রেরিত শাহী ফরমানযোগে ৪২টি মৌজা মাদদ মাস স্বরূপ দান লাভ করেন (১০৩০ হিজরি)। তখন শালিমানা ছিল ৮ হাজার টাকা। হজরত আবদুল ওয়াহাবের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্রের মধ্যে হজরত শাহ মোহম্মদ রফিক (রহ.) ১০২৮ হিজরি সনে ২০৩৭ আনা শালিমানার সম্পত্তি ওয়াকফ করেন।
ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি (ষষ্ঠ রইশ) সাইজুল ইসলামের আমলে রইশ পরিবার ও বাইরের পর্দানশীন মহিলাদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়। তারা এ মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকে থাকা এ শৈল্পিক স্থাপনার শরীরজুড়ে এখন শুধুই অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। মসজিদের দেয়ালের কিছু কিছু অংশের পলেস্তারা ধসে পড়েছে। তবে বর্তমানে এ মসজিদে আর নামাজ আদায় হয় না। ওয়াকফ এস্টেটের বর্তমান মোতাওয়াল্লি খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম রইশ বলেন, এ মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করেছে। মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরনো নকশা অক্ষুণ্ণ রেখে সংস্কারের দায়িত্ব এখন তাদের।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, মসজিদের সামনের জায়গা বর্তমান মোতাওয়াল্লি খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করেছেন। ইসলামী একাডেমী উচ্চ বিদ্যালয় নামক ওই প্রতিষ্ঠান মসজিদের মুখোমুখী নতুন স্থাপনা গড়ে তুলেছে। ফলে মাজারে আসা দর্শনার্থীরা আর সেই মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারেন না।
রইশ খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম বলেন, যে জমিটি বিক্রি করেছি সেটি আমার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই মসজিদটিকে ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করেছে। আমরা ওয়াকফ এস্টেট মাজারের কাছেই নারীদের নামাজ আদায় করার জন্য নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ করেছি। একই সাথে শাহী মসজিদে জুম্মাবারে মুসল্লীদের জায়গা সংকলন হওয়ায় এখানে পুরুষদের জন্য আরো একটি পৃথক মসজিদ নির্মাণ করেছি। বর্তমানে দর্শনার্থীরা মাজার জিয়ারতে এলে এই দুই মসজিদে নামাজ আদায় করে থাকেন। তিনি খুব শীঘ্রই নারীদের জন্য নির্মিত পুরাতন মসজিদে যাওয়ার রাস্তা করে দিবেন বলে জানান।
তবে রইশ পরিবারের পরবর্তী ওয়ারিশ খন্দকার মনোয়ারুল ইসলাম মামুন দাবি করেছেন, ঐ জমি তিনি এককভাবে বিক্রি করতে পারেন না। আদালতে মাজারের দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব সংক্রান্ত একটি মামলা চলমান রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ (প্রত্নতত্ত্ব) আর্কোলজি বিভাগ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা বলেন, এই মসজিদটি সংস্কারের জন্য আমরা চাহিদা পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলেই সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।