মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

রসুল (স.)-এর ব্যক্তিজীবনের কতিপয় অনুপম দিক

আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:৩৫

রসুল (স.) হচ্ছেন আমাদের জন্য উসওয়াতুল হাসানা বা সর্বোত্তম আদর্শ। তার জীবনাদর্শ অনুসরণ অপরিহার্য। নিম্নে তার ব্যক্তিজীবের কিছু অনুপম দিক আলোচিত হলো:

১. প্রথমে সালাম দিতেন: রসুল (স.)-এর ব্যক্তিজীবনে কুশল বিনিময়ের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি প্রথমে সালাম দিতেন এবং মুসাফাহা করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি রসুল (স.)-এর সঙ্গে পথ চলছিলেন। তখন রসুল (স.) কয়েকটি শিশুকে অতিক্রম করছিলেন। তিনি তাদের সালাম দিলেন।’ (মুসলিম, হাদিস:৫৭৯৩)। সালাম প্রদান সম্যক গুরুত্বপূর্ণ বলেই রসুল (স.) অনেক সময় তিন-তিন বার সালাম দিতেন (বুখারি, হাদিস:৯৪, ৯৫, ইফা, হাদিস:৯৫)।

২. ব্যক্তিগত কথা গোপন রাখতেন: রসুল (স.) কারো গোপন বিষয় প্রকাশ করতেন না, এমনকি কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন বা মাসআলা যদি কেউ জানতে চান, যেটি অন্যদেরও প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে তিনি যখন সে বিষয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নিতেন, তখন ঐ ব্যক্তির নাম না নিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, নবিজি (স.)কে কোনো ব্যক্তির কোনো বিষয়ে জানানো হলে তিনি এভাবে বলতেন না, ‘তার কী হলো যে, সে এ কথা বলে?’ বরং বলতেন, ‘লোকজনের কী হলো যে, তারা এই এই বলে?’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস:৪৭৮৮)।

৩. ক্ষমা করতেন: রসুল (স.)-এর জীবনের অনুপম ম্যানার হলো তিনি ঘোরতর শত্রুকেও ক্ষমা করতে কুণ্ঠিত হতেন না। এমনকি সাহাবাদেরও ক্ষমার দীক্ষা দিতেন প্রতিনিয়ত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক লোক এসে রসুলুল্লাহ (স.)কে বলল, আমাদের গোলাম-কর্মচারীরা তো ভুলত্রুটি করে থাকে; তাদের আমরা কত বার ক্ষমা করব? উত্তরে রসুল (স.) কিছু না বলে চুপ রইলেন। লোকটি আবার প্রশ্ন করল। এবারও  তিনি চুপ রইলেন। লোকটি যখন তৃতীয় বার প্রশ্ন করল, তখন রসুল (স.) বলেন, ‘প্রতিদিন তাকে ৭০ বার মাফ করে দেবে’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস:৫৬৩৫)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবি) আপনি ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করুন এবং মানুষকে ভালো বিষয়ের আদেশ করুন। আর মূর্খদের উপেক্ষা করুন’ (সূরা আরাফ, আয়াত:১৯৯)। মক্কা বিজয়ের পর তিনি প্রতিশোধস্পৃহাকে দমিয়ে রেখে ঘোরতর শত্রুদের ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা’ করেন।

৪. অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন: রসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে। দুনিয়ার জীবনকে তিনি মনে করতেন মুসাফিরখানা। এ কারণে পছন্দ করতেন মুসাফির কিংবা নিঃস্বদের মতো জীবন যাপন করতে। (মুসলিম-১৪৭৯)। তিনি সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন এবং খেজুরপাতার চাটাইয়ে বিশ্রাম নিতেন। একদিন তার শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে উমর (রা.) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘রোম ও ইরানের সম্রাটরা ভোগবিলাসে মত্ত, আর আপনার এই অবস্থা!’ রসুল (স.) জবাব দিয়েছিলেন, ‘উমর! তুমি কি এতে খুশি নও যে, তারা দুনিয়া নিয়ে থাকুক আর আমরা আখিরাত লাভ করি?’ (বুখারি, হাদিস:৪৯১৩, মুসলিম, ১৮/৫, হাদিস:১৪৭৯)।

৫. পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি চলাফেরা করতেন: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছিল রসুল (স.)-এর অন্যতম আকর্ষণ। তার প্রতিটি সকাল শুরু হতো মেসওয়াক ও অজুর মাধ্যমে এবং দিনের পরিসমাপ্তি ঘটত মেসওয়াক শেষে এশার সালাত আদায়ের মাধ্যমে, এমনকি মুখে দুর্গন্ধ হয় এমন খাবার খাওয়াকে অপছন্দ করতেন। রসুল (স.) নিয়মিত গোসল করতেন এবং প্রতি সপ্তাহে নখ-গোঁফ কাটতেন। নিয়মিত দাড়ি আঁচড়াতেন এবং চুলে তেল দিয়ে সুন্দর করে সিঁথি কেটে চুলের যত্ন নিতেন। পরিষ্কার কাপড় পরিধানের পর সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং সব সময় সুন্দর-পরিপাটি অবস্থায় থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি বলেন:‘আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’ (মুসলিম:১১৬, তিরমিজি:১৯৯৮, ১৯৯৯)।

৬. বিশুদ্ধ, পরিমিত ও সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন: হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী রসুল (স.)-এর কথার মধ্যে পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হতো, যেমন:১. স্পষ্টতা, ২. বাহুল্য দোষমুক্ত, ৩. শালীনতা, ৪. ধীরস্থিরতা, ৫. মিষ্টভাষী এবং ৬. শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রসুল (স.)-এর কথা এত সুস্পষ্ট ছিল যে প্রত্যেক শ্রোতা তার কথা বুঝতে পারতেন’ (আবু দাউদ, হাদিস:৪৮৩৯)।

৭) মার্জিত রসবোধ: রসুল (স.) বিভিন্ন বয়সি মানুষের সঙ্গে মনন বুঝে মাঝেমধ্যে মার্জিত রসিকতাও করতেন। যেমন:সাহাবি আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেছেন, ‘নবি করিম (স.) কখনো কখনো আমাকে ‘দুই কানওয়ালা’ বলে ডাকতেন’ (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস:২৩৬)।

৮. লজ্জাশীলতা: রসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন সর্বাধিক লজ্জাশীল। কোনো বিষয় অপছন্দ হলে তার চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে যেত। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘যখন তার কাছে অপছন্দনীয় কিছু দেখতাম, তখন আমরা তার চেহারা দেখেই তা বুঝতে পারতাম।’ (বুখারি, হাদিস:৬১০২)।

৯. গৃহস্থালির কাজে সহযোগিতা করতেন: রসুল (স.) শ্রেষ্ঠ মহামানব ও রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও গৃহস্থালির নানা কাজকর্ম করতেন। এমনকি হজরত আয়েশা (রা.)কেও রান্নার কাজে সহযোগিতা করতেন। আসওয়াদ (রা.) বলেন, ‘আমি একবার আয়েশা (রা.)কে জিজ্ঞাসা করলাম, রসুল (স.) ঘরের মধ্যে কী কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন, তিনি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, অর্থাত্ গৃহস্থালির কাজে পরিবারের সহযোগিতায় থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো, তখন নামাজে চলে যেতেন। (বুখারি, হাদিস:৬৭৬)

১০. মানবিক কাজ করতেন: রসুল (স.) সর্বদা মানবিক কাজ করতেন। অসুস্থদের সেবা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, অভাবী তথা নিঃস্বদের তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। রাষ্ট্রে ‘বায়তুল মালের’ একটি বিশেষ অংশই খরচ করা হতো মানবিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে।

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন