শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

ঈদুল আজহা: ত্যাগের মহিমায় আনন্দের উৎসব

আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্য, কঠোরতম ত্যাগ-তিতিক্ষা আর আত্মোত্সর্গের অকপট প্রেরণায় উজ্জীবিত পবিত্র ঈদুল আজহা। কবি নজরুল ইসলাম উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন:  এলো স্মরণ করিয়ে দিতে উদজ্জোহার এই সে চাঁদ/ তোরা ভোগের পাত্র ফেললে ছুড়ে ত্যাগের তরে হূদয় বাঁধ। কোরবানির ঈদকে সঠিক পরিচয়ে তিনি তুলে ধরেছেন এবং এ দেশের মুসলমানদের হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো প্রাণপ্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবান করার মহান আদর্শ অনুসরণ করতে এ দেশের তরুণ সমাজকে ডাক দিয়েছেন

আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২২, ০৭:০৫

পবিত্র ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় ভাস্কর মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান বার্ষিক পর্ব মহান রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে নিজেদের সবচেয়ে প্রিয়বস্তু নিবেদনের শিক্ষা নিয়ে আগমন করে। ইসলামি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে মুসলমানরা দুই রাকাত নামাজ ও পশু কোরাবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহা উদ্যাপন করে। রমজানের শেষে ফিতরা আদায় আর ১০ জিলহজ কোরবানি করে সচ্ছল মুসলমানরা যেমন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়, তেমনি অসচ্ছল মানুষদের শরিক করে নেয় আনন্দ উপভোগ। এভাবে ইসলামের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির আদর্শ আরো উজ্জ্বল হয়।

কোরবানি হাদিসের পরিভাষায় বলা হয়, ‘উজহিয়্যাহ’ অর্থাত্ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যা জবেহ করা হয়। শরিআতের পরিভাষায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট তারিখে, নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট পশু জবেহ করাকে উযহিয়্যাহ বা কোরবানি বলে। কোরবানি শব্দের অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। মুসলমানেরা কোরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হন। উযহিয়্যাহ শব্দটি চারটি পরিভাষায় ব্যবহূত হয়। এক. উদ্হিয়্যা, দুই. ইদ্হ্যা, উভয় শব্দের বহুবচন আদাহী, তিন. দাহ্যিতুন, বহুবচন দাহায়া, চার. আদ্হাতুন বহুবচন আদহা। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য ও ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ পবিত্র হজ্জ পালনের পাশাপাশি পশু কোরবানি দিয়েই এই উত্সব পালন করে। এই কোরবানি আল্লাহর রাহে আমাদের ত্যাগের প্রতীকী রূপ। এটা কোনো রীতি, অভ্যাস, সামাজিক বিধান নয়। এটা আল্লাহর হুকুম ও ইবাদত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা সুরা হাজ্জ-এর ৩৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন।

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রথম স্ত্রী সারার গর্ভে দীর্ঘদিনেও কোনো সন্তান না হওয়ায় হজরত ইবরাহিম (আ.) বার্ধক্য বয়সে মিশরে এসে হাজেরা নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং হাজেরাকে নিয়ে তার মূল বাসভূমি কানআনে তিনি ফিরে আসেন। ইবরাহিম (আ.) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে একটি পুত্রসন্তানের জন্য দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেন। এর ৮৬ বছর বয়সে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। ইতিপূর্বে হজরত ইবরাহিম (আ.) মহান প্রভুর দেওয়া একাধিক পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। যেমন আগুনে নিক্ষেপ করার পরীক্ষা। তারপর দেশান্তর হওয়ার পরীক্ষা। এরপর বিবির ওপর জালিম বাদশার লোলুপ দৃষ্টির পরীক্ষা। যাও-বা বুড়ো বয়সে একটি সন্তান দেওয়া হয় তাকে এবং তার মাকে মরু বিয়াবানে বনবাস দেওয়ার পরীক্ষা হয় আবার। মহান প্রভু তার প্রিয় বন্ধুকে আরো যাচাই-বাছাই করার জন্য সর্বশেষ কঠিন পরীক্ষা করলেন। তা হচ্ছে শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) যখন পিতা-মাতার সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন, তিনি তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে নিজ হাতে জবেহ করছেন। নবির স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন নয়, বাস্তব। তাই তিনি কিশোর ইসমাইলকে বিষয়টি বললেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে : ‘সেই ছেলে যখন তার সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করার বয়স পর্যন্ত পৌঁছল, তখন (একদিন) ইবরাহিম তাকে বললেন, বাবা! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বলো, তুমি কী মনে করো। ছেলে বলল, আব্বাজান! আপনাকে যে হুকুম দেওয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীই পাবেন। শেষ পর্যন্ত যখন দুজনই অনুগত হয়ে মাথা নত করে দিলেন এবং ইবরাহিম তার ছেলেকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন, তখন আমি আওয়াজ দিলাম, হে ইব্রাহিম! আপনি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি নেক লোকদেরকে এভাবেই পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা একটা স্পষ্ট পরীক্ষা ছিল। এক বড় কোরবানি ফিদইয়া হিসেবে দিয়ে আমি ঐ ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলাম এবং তার প্রশংসা ও গুণচর্চা চিরকালের জন্য পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে রেখে দিলাম। ইবরাহিমের ওপর সালাম। আমি নেক লোকদের এভাবেই পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তিনি আমার মুমিন বান্দাহদের মধ্যে একজন ছিলেন।’ (সুরা সাফ্ফাত :১০২-১১১)

নজরুল ইসলাম কোরবানির সেই অপূর্ব ইতিহাস তুলে ধরে জাতিকে নব-জাগরণে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন। কোরবানির ঈদকে নজরুল ইসলাম জাতিকে জাগ্রত করবার প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কবি বলেন: ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন/ দুর্বল ভীরু চুপরোহ, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন। (কোরবানি)

আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্য, কঠোরতম ত্যাগ-তিতিক্ষা আর আত্মোত্সর্গের অকপট প্রেরণায় উজ্জীবিত পবিত্র ঈদুল আজহা। কবি নজরুল ইসলাম উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন: এলো স্মরণ করিয়ে দিতে উদজ্জোহার এই সে চাঁদ/ তোরা ভোগের পাত্র ফেললে ছুড়ে ত্যাগের তরে হূদয় বাঁধ। কোরবানির ঈদকে সঠিক পরিচয়ে তিনি তুলে ধরেছেন এবং এদেশের মুসলমানদের হজরত ইবরাহিম (আ.) এর মতো প্রাণপ্রিয় বস্ত্তকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কোরবান করার মহান আদর্শ অনুসরণ করতে এ দেশের তরুণ সমাজকে ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ডুবে ইসলাম আসে আঁধার/ ইবরাহিমের মতো আবার/ কুরবানী দাও প্রিয় বিভব। ‘জবীহুল্লাহ’ ছেলেরা হোক/ যাক সব কিছু—সত্য রোক/ মা হাজেরা হোক মায়েরা সব। (মেহেদী ঈদ)

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকা

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib