মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আমাদের দুঃখ যেইখানে

আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩০

স্বাধীনতার ৫২ বত্সর পার হইলেও একটি সাধারণ প্রশ্ন সকলের মনেই জাগে—আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে কতখানি গুণগত পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে? ইহা ঠিক যে, অর্থনৈতিক দিক হইতে কয়েক যুগ ধরিয়া বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সক্ষমতা অর্থনীতিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটাইয়াছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলিও যথেষ্ট ইতিবাচক; কিন্তু ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিকের জীবনে সম্পত্তি সুরক্ষার মান কতখানি বাড়িয়াছে? ইহার পাশাপাশি প্রশ্ন তোলা যাইতে পারে, কীভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের দুষ্টচক্র হইতে বাহির হইয়া আসা যায়?

অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন। কারণ প্রশ্নটি আদর্শিক এবং তাহা বাংলাদেশের সৃষ্টির সহিত জড়িত। কেবল বাংলাদেশ নহে, ষাট, সত্তর বা আশির দশকে যেই সকল দেশ স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিল, আমরা দেখিতে পাই, সেই সকল দেশে একধরনের ‘আনফিনিশ্ড রেভল্যুশন’ অবস্থা বিরাজ করিতেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক বেনেডিক্ট রিচার্ড ও’গর্ডন অ্যান্ডারসন তাহার ‘ইমাজিনড কমিউনিটিস’ গ্রন্থে বলিয়াছেন, নূতন রাষ্ট্র গঠনের পর সেই রাষ্ট্রের অধিবাসীরা ‘ইতিহাসের এক নূতন যুগ’, ‘সূর্যোদয়’ প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করিয়া থাকে। স্বাধীনতার সময় সদ্য স্বাধীন দেশের অধিবাসীরা একধরনের ঘোরের মধ্যে থাকেন, তাহারা একধরনের স্বাপ্নিক আকাঙ্ক্ষার ফানুসে ভাসেন; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা হইল, তাহারা স্বাধীনতার পরও অস্থিতিশীল ভূখণ্ডেরই বাসিন্দা থাকিয়া যান। ইহা বুঝিতে হইলে আমাদের দৃষ্টিপাত করিতে হইবে এই পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠনশৈলীর দিকে। আদি পৃথিবীর ভূগঠনের সময় মাটির নিচের টেকটোনিক প্লেটের ঘনঘন সংঘর্ষ হইত। প্রতিটি সংঘর্ষে কাঁপিয়া উঠে সেই অংশের ভূখণ্ড। বত্সরের পর বত্সর ধরিয়া এই রকম টেকটোনিক প্লেটের বারংবার সংঘর্ষের পর একসময় ধীরে ধীরে ভূখণ্ডগুলি স্থিতিশীল হইতে থাকে। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির বৈশিষ্ট্যও একই রকম। জীবন্ত আগ্নেয়গিরি বেশির ভাগ শান্ত-চুপচাপ থাকে; কিন্তু যে কোনো সময়, যখন-তখন উহার ভিতর দিয়া তপ্ত লাভার উদিগরণ ঘটিতে পারে। এই বিশ্বের বহু স্থানেই ভূরাজনৈতিক অবস্থা ঐ আদি টেকটোনিক প্লেট আর আগ্নেয়গিরির মতো। তাহারা উপরে কথিত স্থিতিশীল; কিন্তু ভিতরে ভিতরে অস্থিতিশীল। এই অস্থিতিশীলতা হইল এই সকল রাষ্ট্রের আনফিনিশ্ড রেভল্যুশন। এই অসমাপ্ত বিপ্লবের রেশ বহু বত্সর ধরিয়া চলিতে পারে। সুতরাং যেই বিপ্লব অসমাপ্ত, যেই ভূখণ্ডের টেকটোনিক প্লেটে ঝামেলা রহিয়াছে, সেইখানকার মাটি ঘনঘন কাঁপিবেই। যেই আকাশে যেই কৃষ্ণমেঘ জমা রহিয়াছে, তাহা হইতে ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি তো হইবেই। যত দিন না সেই মেঘের পুরাপুরি ক্ষয় হইতেছে, তত দিন বৃষ্টির দমক থামিবে না, তত দিন প্রকৃতিও থমথমে থাকিবে। সুতরাং অসমাপ্ত বিপ্লব যেইখানে ঘটিয়াছে, সেইখানে সহিংসতা, হানাহানি, বড় বড় হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান-পালটা অভ্যুত্থানসহ সকল কিছু মিলাইয়া একটি কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতা তৈরি হইয়া আসিতেছে বহু যুগ ধরিয়া। ইহার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনো বিশ্বের নানান রাষ্ট্রে দেখা যাইতেছে।

মনে রাখিতে হইবে, এই সকল টেকটোনিক প্লেট হইল বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিরা। আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভাও ঐ পরাশক্তিরা। তাহারা একসময় নিজেদের উপনিবেশ ছাড়িয়া ঘুড়িকে আকাশে স্বাধীনভাবে উড়িবার অধিকার দিয়াছে বটে; কিন্তু লাটাই রাখিতে চাহিয়াছে নিজেদের হাতেই। এই জন্য অসমাপ্ত বিপ্লবের এই ধরনের দেশ কার্যত বহু ক্ষেত্রে অসহায়। এই অবস্থা হইতে উত্তরণের জন্য এই সকল দেশে দরকার যথাযথ শিক্ষা, নিজেদের মধ্যে ঐক্য। ইহা সহজ নহে। কেননা, ঐক্য যাহাতে তৈরি হইতে না পারে, তাহার জন্য অতি লোভনীয় প্ররোচনার শেষ নাই; কিন্তু দিনের শেষে নিজেদের বুঝ নিজেদেরই তো বুঝিতে হইবে। দুঃখজনকভাবে নিজেদের সেই বুঝ ৫২ বত্সরেও তৈরি হয় নাই। নিশ্চয়ই একদিন আমরা এই সকল সংকট হইতে বাহির হইতে পারিব; কিন্তু ইহার মধ্যবর্তী সময়ে অর্থসম্পদের কত না জানি ক্ষতি হইবে, প্রাণক্ষয় হইবে কত শত-সহস্র-অযুত মানুষের! অথচ প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। আমাদের দুঃখ সেইখানেই।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন