ডিএমপি বা ঢাকা মহানগর পুলিশ জানাইয়াছে, গত শনিবার রাজনৈতিক দলসমূহের সমাবেশ-মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করিয়া রাজধানীতে ৯টি বাসসহ অর্ধশতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হইয়াছে। গতকাল হরতালের দিন বিভিন্ন যানবাহনে আগুন লাগাইবার ঘটনা হিসাবে লইলে এই সংখ্যা আরো বাড়িবে নিঃসন্দেহে। অথচ আমরা একটি উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশ। এখনো আমাদের ধারকর্জ করিয়া চলিতে হয়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আজও আমরা বন্ধুপ্রতিম ও দাতাদেশগুলির উপর নির্ভরশীল। ১৮ কোটি মানুষের অন্নসংস্থানের কথা চিন্তা করিতেই যেইখানে সরকার পেরেশান, সেইখানে আমাদের এই অপচয় ও নৈরাজ্য মানায় না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করিয়াছি এবং আমাদের স্বাধীনতার অর্ধশতকেরও অধিক সময় অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে; কিন্তু আজও আমরা স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের রাজনীতির গতিধারা কেমন হওয়া উচিত তাহা ঠিক করিতে পারি নাই। পরাধীন আমলে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আমাদের কৌশল ছিল একরকম; কিন্তু দেশ স্বাধীন হইবার পর একই সহিংস ধারায় আমরা চলিতে পারি না। অবশ্য জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, হানাহানি ইত্যাদি কোন পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়, তাহাও আমাদের অজানা নহে। আমাদের পূর্বপুরুষরা এমনটি করিলেও আমাদের এখন ইহা লইয়া গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করিয়া দেখিতে হইবে। অনুসন্ধান করিতে হইবে ইহার বিকল্প পথ। কেননা এই দেশটা আমাদের সকলের।
একটি বাসের মূল্য কত? আমাদের দেশে কয়েক কোটি মূল্যের উন্নতমানের বাসও চলাচল করে। যেই বাস ও যানবাহনগুলি পোড়ানো হইয়াছে, তাহার মূল্য বিবেচনায় লইলে আমাদের দেশের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে তাহার হিসাব বাহির করা অসম্ভব নহে। অর্থনীতিবিদরাই তাহা ভালো বলিতে পারিবেন। তবে আমাদের প্রশ্ন হইল, আমরা আমাদের সম্পদ এইভাবে নষ্ট করিব কেন? ইহা তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারিবার শামিল। ইহার মূল কারণ কী? আসলে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিদ্যমান শৃঙ্খলার অভাব। এবং এই দেশে অহরহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ ঘটিলেও তাহার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে খুঁজিয়া বাহির করা হয় না বা তাহাকে শনাক্ত করা গেলেও তাহাকে তেমন শাস্তি পাইতে হয় না।
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলির পশ্চাত্পদতার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বত্র নিয়মশৃঙ্খলার অভাবই দায়ী। বলা হয়, ডিসিপ্লিন ইজ ফাস্ট বা শৃঙ্খলাই প্রথম; কিন্তু আমরা মনে করি, আসলে ইহা হওয়া উচিত ‘ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট, ডিসিপ্লিন ইজ সেকেন্ড অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ইজ লাস্ট। অর্থাত্ শৃঙ্খলাই প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ কথা। ইহা ছাড়া উন্নয়নশীল বিশ্বের ভাগ্যোন্নয়ন হইবে না। উন্নত বিশ্বের নিয়ম অনুযায়ী মিটিং-মিছিলের অনুমতি লইলে নির্দিষ্ট স্কয়ার বা এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকিতে হইবে। যেই সকল দেশের রাস্তাঘাটে সামান্য ময়লা ফেলিলেও বড় ধরনের জরিমানা গুনিতে হয়, সেই সকল দেশে বিশৃঙ্খলার কোনো স্থান নাই; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে এই সকল ব্যাপারে তোয়াক্কা করা হয় না। এইখানে আমরা যেন ‘সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
অতএব উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পূর্বে ডিসিপ্লিন শিখানোর ব্যবস্থা করিতে হইবে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলিয়া ধরা প্রয়োজন। কেননা শৃঙ্খলা মানবজীবনের উন্নয়নের জন্যই অপরিহার্য। কোনো জাতি সর্বত্র শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় প্রদান ব্যতীত কখনো উন্নত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারে না; কিন্তু বাঙালি জাতি হিসাবে এই ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা হতাশাজনক। আমাদের এইখানে অফিস-আদালত, সড়ক-মহাসড়কসহ কোথায় নাই বিশৃঙ্খলা? অবশ্য বিশৃঙ্খলা এই উপমহাদেশেরই একটি বড় সমস্যা। এতদঞ্চলে মোগল, ব্রিটিশসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন শাসন করিলেও তাহাদের সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করিবার বিষয়টি ছিল গৌণ। আবার বিদেশি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আমরা বারংবার বিদ্রোহ করিবার কারণেও শান্তি, স্থিতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হইয়াছে। তবে স্বাধীন দেশে আমাদের এই পরিচয় যেন না হয় যে, আমরা একটি বিশৃঙ্খল জাতি।