আরবি শব্দ ‘সায়মা’ অর্থ হইল—উপবাস তথা রোজা। রোজা হইল সংযমের সাধনা। এই সাধনা হইল আত্মসংযমের, আত্মোত্সর্গের। নিজের জন্য নহে, মানুষের জন্য আত্মোত্সর্গের। সায়মা ওয়াজেদ তাহার অর্ধশতবর্ষ জীবনের মানবিক পাঠের পরীক্ষায় নূতন পুরস্কারে ভূষিত হইয়াছেন। বাংলাদেশ, ভুটান, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তিমুর-লেস্তে ও মিয়ানমার—এই ১১টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বিজয়ী হইয়াছেন সায়মা ওয়াজেদ। কেবল মিয়ানমার এই ভোটে অংশগ্রহণ করে নাই। বাকি ১০ দেশের ভোটের মধ্যে আট-দুই ভোটের বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত হইয়াছেন সায়মা। সায়মার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নেপালের ডা. শম্ভুপ্রসাদ আচার্য বিজয়ী সায়মাকে অভিহিত করিয়াছেন ‘অমূল্য সম্পদ’ হিসাবে। সায়মার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা দ্বারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যে বিশেষভাবে উপকৃত হইবে—তাহাও নির্দ্বিধায় উল্লেখ করিয়াছেন তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী ডা. শম্ভুপ্রসাদ।
কী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রহিয়াছে সায়মা ওয়াজেদের? আমরা দেখিয়াছি, সায়মা ওয়াজেদ চিরকাল তাহার মনুষ্যত্বের নিশান ঊর্ধ্বাকাশে তুলিয়া রাখিতে ঋজু হইয়া চলিয়াছেন। ব্রতী হইয়াছেন মানবসেবায়। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মানসজগতে এই বোধ জাগ্রত করিয়াছেন যে, শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হইবার বিষয়টি কোনো পাপের নহে, বরং এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদেরও রহিয়াছে ভালোমতো বাঁচিয়া থাকিবার অধিকার। উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিচর্যা পাইলে এই ধরনের শিশুরাও সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সৃজনশীল কাজ করিয়া দেখাইতে পারে। অটিস্টিক শিশুদের বাবা-মায়ের ভয়াবহ মনস্তাপ ও কষ্টের অনল হইতে উদ্ধার করিতে অভাবনীয় অবিস্মরণীয় সকল কাজ করিয়াছেন মানবতাবাদী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। তিনি ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় হইতে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল মনস্তত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির উপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নসংক্রান্ত তাহার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসাবে স্বীকৃত হয়। ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়বিক জটিলতাসংক্রান্ত বিষয়ের উপর কাজ শুরু করিবার পর তিনি ২০১১ সালে ঢাকায় অটিজম-বিষয়ক প্রথম দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেন সায়মা ওয়াজেদ। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি প্যানেলের সদস্যও হন তিনি। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাহাকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ‘হু এক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যসেবায় অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ তিনি ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ব্যারি ইউনিভার্সিটি ‘ডিসটিংগুইসড অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ডস’ অর্জন করেন। ২০১৬ সালে সায়মা ওয়াজেদ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে অটিজম-বিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চ্যাম্পিয়ন হিসাবে মনোনীত হন সায়মা ওয়াজেদ। ২০২০ সালে তিনি সিভিএফের থিম্যাটিক রাষ্ট্রদূত হন। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য গঠিত ফোরামের কাজে তাহার সম্পৃক্ততা কোভিড-১৯ মহামারিতে প্রশংসিত হইয়াছে। অতঃপর ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান পদে গতকাল বুধবার সায়মা ওয়াজেদ প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে বিজয় অর্জন করিলেন। এই পদে পাঁচ বত্সরের জন্য দায়িত্ব পালন করিবেন আগামী বত্সর পহেলা ফেব্রুয়ারি হইতে।
বঙ্গবন্ধুর নাতনি, পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা দম্পতির গৌরবোজ্জ্বল কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। স্বমহিমায় আলোকিত সায়মা ওয়াজেদের কল্যাণ হউক। তাহার মানবিক আলোক রশ্মির অপূর্ব রোশনাই ঋদ্ধ করুক এই বিশ্বকে।