মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিদেশে উচ্চশিক্ষায় নারীর যত প্রতিবন্ধকতা

আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১৩:০১

বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে কিন্তু সে অনুযায়ী নারী শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে আছে। দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নারী–পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই রয়েছে নানা জটিলতা। তবে কিছু সমস্যা আছে, যা শুধু নারীর ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে সক্ষম হন হাতগোনা কিছু সংখ্যক নারী শিক্ষার্থীরা। সেই স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীরাও মুখোমুখি হন নানা প্রতিবন্ধকতার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষা, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সূচকে দেশ এগিয়ে গেলেও বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথে এখনো নারীদের অনেক বাধা। বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। অভিভাবকের মনমানসিকতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, প্রতিকূল সমাজব্যবস্থা, নিরাপত্তাহীনতা ও সদিচ্ছার অভাবে নারীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণে পিছিয়ে আছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জানিয়েছেন নানা প্রতিবন্ধকতার কথা।

এ প্রসঙ্গে মোবাইলে কথা হয় কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয় বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বাংলাদেশী শিক্ষার্থী লায়লা ফজল হীরার সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, শিক্ষার জন্য এখন অনেক দূর যাচ্ছেন আমাদের দেশের নারী শিক্ষার্থীরা। বাবা-মাও মেয়েদের এখন আলাদা করে মেয়ে সন্তান হিসেবে মানুষ করছেন না, সন্তান হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম বাঁধাটা আসে পরিবার থেকেই। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে প্রায়ই একটি মেয়ের অভিভাবকদের প্রভাবিত করে। অভিভাবকদেরও এমন বলতে শোনা যায়, ‘মেয়েকে পড়াশোনা করতে বাইরে পাঠিয়ে কী হবে? তার চেয়ে বরং বিয়ের জন্য টাকা গোছাও। শেষে তো ওইটাই কাজে আসবে। মেয়ের পড়ার পেছনে এত অযথা খরচ করো না।’ এতে করে মেয়েদের অভিভাবকও মেয়েদের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। অনেক অভিভাবকের ভাবনা মেয়েকে যদি উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে পাঠাই তবে উচ্চশিক্ষিত হয়ে যাওয়ার পর তার জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া সমস্যা হবে। তাই অনেক অভিভাবকই মেয়েকে বিদেশে পড়াতে চান না। এছাড়া বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অনীহা থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে ‘প্রক্রিয়া’। অনেকই মনে করেন তারা এসব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারবেন না। বিদেশে একজন 'সিঙ্গেল' নারী শিক্ষার্থীর দায়িত্ব এবং কাজ বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে বেশ কিছু প্রতিকূলতা তাকে পোহাতেই হয়। কেন একা পড়তে এলাম? কেন এখনো বিয়ে করিনি, এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে কদাচিৎ। 

তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার বাবা-মা আমাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে, আমি কখনও অনুভব করতে পারিনি আমি তাদের মেয়ে সন্তান এবং আমাকে সেইভাবে তৈরি করেছেন। দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে এসেছি এতে বাবা-মা কখনো বাধা দেননি। আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে, বিদেশ যাত্রা মানেই মেয়ে তাদের হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া নয় বরং তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়া।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী অন্তু রানী হালদার ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায় মেয়েরা সমান সুযোগ পেলেও বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যেতে বিভিন্ন বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হন। সেটা পরিবার কিংবা সমাজ কর্তৃক হতে পারে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেকোন মেয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দেশে বাহিরে যেতে চাইলে তাকে নিয়ে নানা রকম নেতিবাচক কথা বলা হয়। বিদেশে পড়তে গেলে মেয়েরা খারাপ হয়ে যেতে পারে এমন ধারণা রয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে সুযোগ পেয়েও যেতে পারে না। 

উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা দেশের বাইরে যেতে না চাওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। আমার মতে, এক্ষেত্রে প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার অভাব। বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হলে অবশ্যই আর্থিক সামর্থ্য থাকতে হবে, যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ  দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে সেক্ষেত্রে তারা ইচ্ছে থাকলেও সন্তানকে বিদেশে পাঠাতে পারেবনা। বাইরে যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা অনেক পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। তাই অনেকটাই পিছিয়ে যায় নারী শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে হলে সবার আগে নির্ধারণ করতে হয় কোথায় থাকবে? আদৌ সেটা একটা মেয়ের জন্য নিরাপদ হবে কিনা? সেই অনিশ্চিয়তায় থাকতে হয়। যেটা একটা অন্যতম সমস্যা। অনেক বাবা-মা মনে করেন, দেশের বাইরে গেলে কে তাদের মেয়ের নিরাপত্তা দেবে, সমাজ কী বলবে? এসব চিন্তা করে। আবার বাইরের দেশের সাথে আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে রয়েছে অনেক ভিন্নতা। পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রে এটা বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অনেক মেয়ে পরিবার থেকে বাধা পেয়ে থাকেন।   

এ প্রসঙ্গে কথা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহানাজ পারভীনের সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় নারীদের বাধা সীমাহীন। তার পিছনে অনেক ধরনের কারণ রয়েছে। প্রথমত আমাদের সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ এখনো মনে করে একজন নারী একা কিছু করতে পারবে না। নারীদেরকে এখনো দুর্বল ভাবা হয়। এক্ষেত্রে  সামাজিক নিরাপত্তা ও অনেকখানি দায়ী নারীদের পিছিয়ে পড়ার পিছনে। আমাদের সমাজে এখনো নারীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব। উচ্চশিক্ষায় নারীদের বিদেশ গমনে সামাজিক বাধার পরেই আসে পারিবারিক বাধা। বিয়ে করা ছাড়া যাওয়া যাবে না, একা যাওয়া যাবে না, একা থাকা যাবে না। এই ধরণের অনেক কথা শুনতে হয় নারীদের। এছাড়া অনেক অভিভাবক এখনো কেবল মেয়ের ‘ভালো বিয়ে’ দিতে তাকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলা দরকার বলে মনে করেন। এই মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। কেবল বিয়ের কথা না ভেবে মেয়েকে সমাজে স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে, স্বাবলম্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তোলার জন্য উচ্চশিক্ষিত করে তোলার কথা অভিভাবকদের গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। সবশেষে আমি বলবো উচ্চশিক্ষায় নারীদের পিছিয়ে পড়ার জন্য নারীরা নিজেরাই দায়ী। পারিবারিক দায়বদ্ধতা, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি মায়া, বাবা-মায়ের প্রতি টান সবকিছু মিলিয়ে নারীরা এখনো দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হকের সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে নারীদের বাধার বিষয়টি আসলে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। বাইরে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এখন আগের মত বাধার সম্মুখীন হন না। নারীদের মধ্যেও উপলব্ধি এসেছে। বাবা মায়ের মধ্যেও এই বোধ এসেছে, মেয়েটাকে উচ্চশিক্ষিত করতে হবে এবং এবং বাইরের উচ্চশিক্ষা তার জীবনকে প্রভাবিত করবে। অনেকেই মেয়ে স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে যাচ্ছে। সবার মধ্যেই একটা পরিবর্তন এসেছে। 

তানিয়া হক আরও বলেন, নারীদের দেশের বাইরে যাওয়া হয়তো পুরুষ শিক্ষার্থীদের তুলনায় কম কিন্তু আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এটা যত সামনের দিকে তুলে ধরা যাবে মানুষ ততো উৎসাহিত হবে। আগের থেকে মানুষের চিন্তা চেতনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এটাকেও আমি একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বলতে চাই তবে এখানে আরো কাজ করতে হবে। যাতে বিয়ের কারণে, বাচ্চার কারণে এবং আর্থিক দিক যেন মেয়েদের বিড়ম্বনার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। সেই ব্যাপারে আমাদের আরো কাজ করার জায়গা রয়ে গেছে। এটি আসলে একা কাজ করার জায়গা না। সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহ সকল স্টেকহোল্ডারদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা পদক্ষেপ নিতে পারে, দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ভাবে কাজ করতে পারে যাতে নারী শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে যেতে সুযোগ পায়।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন