পাগলেও নাকি নিজের ভালো বুঝে। যে কোনো ব্যাপারে নিজের উপকার, লাভালাভ, সুযোগ-সুবিধা পৃথিবীর সকল মানুষ অবচেতনে পরিমাপ করিয়া দেখে। মানসিক সন্তুষ্টি ব্যতীত কেহ কিছু করিতে চাহে না। ইহাকেই অনেকে স্থূল অর্থে ‘স্বার্থ’ বলিয়া থাকে। সুতরাং এক অর্থে আমরা সকলেই স্বার্থপর এবং তাহা দোষণীয়ও নহে। বরং নিজের অস্তিত্বের জন্য সকলকেই স্বার্থপর হইতে হয়। তবে উহারও একটি সীমা রহিয়াছে। নিন্দা-তত্ত্ব প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, ‘স্বার্থ যখন স্বার্থপরতার সাধারণ সীমা ছাপিয়ে উঠে, তখনই আমরা তাকে স্বার্থপরতা বলি।’ একইভাবে ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি বলিয়াছেন, ‘মানুষের দায় মহামানবের দায়, কোথাও তার সীমা নেই। অন্তহীন সাধনার ক্ষেত্রে তার বাস। জন্তুদের বাস ভূমণ্ডলে, মানুষের বাস সেইখানে যাকে সে বলে তার দেশ। দেশ কেবল ভৌমিক নয়, দেশ মানসিক। ...বহু লোকের আত্মত্যাগে দেশের গৌরব সমুজ্জ্বল।’ আবার প্রাকৃতিক নির্বাচনে ডারউইন বলিয়া গিয়াছেন—সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট—অর্থাত্ যোগ্যতমরাই টিকিয়া থাকিবে। এইখানেও বুদ্ধি ও স্বার্থের প্রশ্ন আসে সারভাইভের জন্য।
বাস্তবিক অর্থে একবিংশ শতাব্দীর এই পৃথিবীটা বড়ই জটিল এবং কঠিন। জ্ঞানীরা উপলব্ধি করিতে পারেন—হিংসায় উন্মত্ত নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বের ঘোর কুটিল ধরণিতে টিকিয়া থাকাটাই অনেক বড় ব্যাপার। সেই জন্য যাহারা টিকিয়া আছেন, মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট তাহাদের শুকরিয়া জানানো উচিত। তবে আমরা এই চিত্রের বিপরীতে দেখিতে পাই, এই পৃথিবীতে কত ধরনের ভূরাজনৈতিক খেলা চলিতেছে! আমরা সেই ‘খেলা’র খুব সামান্যই বুঝিতে পারি। অনেকের মতে, আমরা আসলে দেখিতে পাই সাগরে ভাসমান হিমবাহের উপরের দৃশ্যমান সামান্য অংশটুকু। হিমবাহের নিচে যে সিংহভাগ অংশ রহিয়া গিয়াছে, আমরা তাহা দেখিতে পাই না। পাইবার কথাও নহে। এই জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের ‘পাওয়ার’ তথা ‘শক্তি’ কী জিনিস, আমরা তাহা জানি না। ইহার পাশাপাশি পরাশক্তির ‘সুপার পাওয়ার’ কী জিনিস, তাহা আমরা বুঝিই না। তবে আমরা না জানি অথবা না বুঝি, এইটুকু জানি বা বুঝি যে, উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোটখাটো দেশগুলির আশপাশে বড় বড় শক্তিশালী দেশ রহিয়াছে, সেইখানে রহিয়াছে অনেক ধরনের হিসাবনিকাশ। এই সকল ছোটখাটো দেশ যেই সকল বিবেচনায় স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে, সেই বিবেচনা অনুযায়ী এই দেশগুলির প্রতি শক্তিশালী দেশের হস্তক্ষেপ করিবার কথা নহে; কিন্তু সমস্যা হইল, এই সমস্ত বড় দেশের সহিত অন্যান্য বড় দেশের একে অন্যের রহিয়াছে জটিল হিসাব। সেই হিসাবের প্যাঁচে কাহারো কাহারো মধ্যে রহিয়াছে বৈরী সম্পর্ক। এই জটিল অবস্থায় উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোট দেশগুলির এমনিতেই অত্যন্ত সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত। কবির ভাষায় ছোট দেশগুলির অবস্থা হইল—‘বহুদিন মনে ছিল আশা/ ধরণীর এক কোণে/ রহিব আপন-মনে;/ ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা/ করেছিনু আশা।’ অর্থাত্ উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোট দেশগুলিও যেন ধরণির এক কোণে আপন মনে এতটুকু জায়গা লইয়াই খুশি থাকিবে। এই সকল পঙিক্তর মধ্যে আমরা যেন এমনই আভাস পাই—ছোটখাটো দেশগুলির কী করা উচিত; কিন্তু এই ছোটখাটো দেশগুলি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র্য’ কবিতার মতো ‘কণ্টক-মুকুট শোভা’ লইয়া কখনো কখনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ ‘সাহস’ দেখায়—যাহাকে নজরুল বলিয়াছেন—‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’।
এই দুরন্ত সাহসের যুক্তি হিসাবে উঠিয়া আসে উন্নয়নের কথা, জিডিপির কথা। আমরা ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকায় দেখিয়াছি দুরন্ত সাহসের পরিণাম কী হয়। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো যাহারা ‘কথা’ দিয়াছে, সকল সময় তাহারা ‘কথা’ না-ও রাখিতে পারে। ‘দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮ নীলপদ্ম/ তবু কথা রাখেনি...।’ সুনীলের কবিতার মতো কেহ যদি কথা না রাখেন, তখন কী হইবে? তবে ইহাও সত্য যে, স্বার্থ ও প্রয়োজন যতক্ষণ রহিয়াছে ততক্ষণ কথা না রাখিয়া উপায় কী?