মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

জাহান্নামের আগুনে বসিয়া পুষ্পের হাসি!

আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৩০

স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন ১৮৮৬ সালে প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ডক্টর জেকিল ও মিস্টার হাইড’। একই মানুষের দুইটি রূপ ছিল—ভালো সত্তাটি হইল ‘ডক্টর জেকিল’ এবং খারাপ সত্তাটি মিস্টার হাইড। গ্রন্থটির মূল বক্তব্য এক কথায় :মানুষ একই সঙ্গে দেবতা ও দানব। এই চিত্র আমরা সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রেই দেখিতে পাই। শুভ সত্তাসম্পন্ন ডক্টর জেকিলদের মাধ্যমে পৃথিবী মানুষের জন্য একদিকে বসবাস উপযুক্ত হইয়া উঠিবার চেষ্টা করিবে, অন্যদিকে অশুভ সত্তার ‘মিস্টার হাইডদের’ মাধ্যমে পৃথিবী অগ্রসর হইতে থাকিবে ধ্বংসের দিকে। ইহা যেন শুভ-অশুভের লড়াই। প্রসঙ্গক্রমে আমরা স্মরণ করিতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তিনসঙ্গী’ গল্পের ‘শেষ কথা’র আংশটি। অচিরা তার নানাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি সেদিন বলছিলে না, মানুষের সত্য তার তপস্যার ভিতর দিয়ে অভিব্যক্ত হয়ে উঠছে? তার অভিব্যক্তি বায়োলজির নয়।’ তখন দাদু বলিলেন, ‘...পৃথিবীতে বর্বর মানুষ জন্তুর পর্যায়ে। কেবলমাত্র তপস্যার ভিতর দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ। আরো তপস্যা সামনে আছে, আরো স্থূলত্ব বর্জন করতে হবে, তবে সে হবে দেবতা। পুরাণে দেবতার কল্পনা আছে, কিন্তু অতীতে দেবতা ছিলেন না, দেবতা আছেন ভবিষ্যতে, মানুষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে।’

অর্থাত্ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার সৃষ্ট চরিত্রের মাধ্যমে জানাইয়াছেন, এই সভ্যতা যতই আগাইয়া যাইবে ততই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়িবে। অন্যদিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বৈজ্ঞানিক অ্যাভি লোয়েব বলিয়াছেন, যেই দিন মানুষ প্রযুক্তির শীর্ষে পৌঁছাইয়া যাইবে, সবচাইতে উন্নত প্রযুক্তিগত ব্যবহারে অভ্যস্ত হইয়া উঠিবে, সেই দিন মানবজাতি ধ্বংসের মুখে পৌঁছাইয়া যাইবে। তিনি মনে করেন, ‘মানুষের লোভের কারণে যেইভাবে পৃথিবীর অবস্থা দিনদিন খারাপ হইতেছে, তাহাতে মনে হয় না মানুষ আর খুব বেশি দিন পৃথিবীতে থাকিতে পারিবে। তিনি বলেন, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ তো রহিয়াছেই, তাহার সহিত মানুষের তৈরি দুইটি আরো ভয়ংকর সমস্যা সম্মুখীন হইবে পৃথিবী। প্রথমটি মহামারি। দ্বিতীয়টি যুদ্ধ। ইতিমধ্যে জলবায়ুর লাগাতার পরিবর্তনে হিমবাহ দ্রুত গলিয়া যাইতেছে। সমুদ্রের উচ্চতা প্রতিনিয়ত বাড়িতেছে। কয়েক শত বত্সর ধরিয়া ঘুমাইয়া থাকা আগ্নেয়গিরিগুলি পুনরায় জাগিয়া উঠিতেছে। দাবানলের সংখ্যা বাড়িতেছে দিনকে দিন। অন্যদিকে বিভিন্ন শক্তিধর দেশে শত শত পারমাণবিক বোমা বসানো-ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা আছে। অন্তত ১ হাজার ৮০০ পরমাণু বোমা রহিয়াছে, যেইগুলি খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে নিক্ষেপ করা যাইবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ইতিপূর্বে বলিয়াছে, বর্তমানে বিশ্বে যেই পরিমাণ পরমাণু বোমা মজুত রহিয়াছে তাহা দিয়া সমগ্র বিশ্বকে ৩৮ বার পুরাপুরি ধ্বংস করিয়া ফেলা যাইবে।

সুতরাং পৃথিবীতে চলিতেছে শুভ-অশুভ শক্তির দ্বন্দ্ব। মানুষই দেবতা, মানুষই দানব। উভয় শক্তিরই দড়ি টানাটানি হইতেছে। যাহার জোর অধিক তাহারই জয় হইবে। কাজী নজরুলের মতো বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া জাহান্নামের আগুনে বসিয়া পুষ্পের হাসি দেওয়া কি কাহারো পক্ষে সম্ভব? এই পৃথিবীকে রক্ষা করিতে হইলে শক্তিবৃদ্ধি করিতে হইবে শুভ সত্তার, যাহাতে বিনাশ ঘটানো সম্ভব হয় দানবসত্তার। আমরা কেবল আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারি, বিধ্বংসী ঝড়বৃষ্টির পর প্রকৃতি শান্ত হইবে, দিকে দিকে যুদ্ধ-অশান্তি-নরহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের পর সকলের নিশ্চয়ই উপলব্ধি ঘটিবে—এই পৃথিবী মানবের তরে, দানবের তরে নহে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন