দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়িয়া চলিয়াছে উদ্বেগজনকভাবে। ইহার পাশাপাশি মামলা, গ্রেফতার, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান ইত্যাদি বৃদ্ধি পাইয়াছে। বৃদ্ধি পাইয়াছে কারাগারে বন্দির সংখ্যাও। বর্তমানে কারাগারগুলিতে ধারণক্ষমতার চাইতে দ্বিগুণ বন্দি রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া তৃণমূল বা স্থানীয় পর্যায়ে অস্থিরতা আরো অধিক। সেইখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একশ্রেণির নেতা-পাতিনেতাদের হুকুমমতো চলিতেছে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগের একশ্রেণির লোকও। স্থানীয় পর্যায়ে যেই সকল জুলুম-অত্যাচার চলিতেছে তাহা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কতটা অবহিত তাহা লইয়া আমরা সন্দিহান। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বিরোধী মতাদর্শী তো বটে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি দলের সহিত জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের যেইভাবে ধরপাকড় ও হয়রানি করা হইতেছে তাহা খুবই ন্যক্কারজনক। ইহা লইয়া আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠাকে আমলে নেওয়া হইতেছে বলিয়া মনে হয় না। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকিলে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা কীভাবে সম্ভব? ইহা যে প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িতেছে!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে, এই নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক কর্মী লাগিবে না। নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সাজ সাজ রব প্রত্যক্ষ করা যাইতেছে না। তাহা হইলে নির্বাচন কীভাবে উঠানো হইবে? এই ব্যাপারে বরং নিন্দুকেরা পালটা প্রশ্ন রাখেন, এই জন্য পুলিশসহ মাস্তান বাহিনী, সন্ত্রাসী এমনকি দাগি, খুনি ও অপরাধীরা থাকিতে চিন্তা কীসের? এখন ভোট যেহেতু বহুলাংশে ভোটারদের উপস্থিতি ও তাহাদের স্বাধীন মতামতের উপর নির্ভর করে না, তাই অনেকেই অযথা ভোটারদের পিছনে খরচ না করিয়া মাসলম্যান গড়িয়া তুলিবার প্রতি মনোনিবেশ করিয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ইহার পাশাপাশি মাদক কারবারসহ নানা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এখন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রভৃতি সংস্থার প্রভাবশালী লোকজনকে নিজের অনুকূলে রাখিবার পিছনে ব্যয় করা হইতেছে। অবশ্য তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ বাধ্য হইয়া পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করিতেছেন। জেলা-উপজেলায় যেই সমস্ত দারোগা-ওসি পাতিনেতাদের কথামতো সম্ভাব্য প্রার্থী কিংবা তাহাদের শীর্ষ নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করিতেছেন, তাহাদের বাড়ি বাড়ি গিয়া হুমকি দিতেছেন, তাহারা এমন কাজটি কেন করিতেছেন তাহা বুঝিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। কোনো মামলা না থাকিবার পরও ভয় দেখানোর কারণ একটাই, যাহাতে এইভাবে নির্বাচনের পূর্বে তাহাদের বাড়ি ও এলাকাছাড়া করা যায়। ইহার পাশাপাশি এই মহাসুযোগে দুই পয়সা কামাইয়া নেওয়া যায়। ইহা ছাড়া মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলার খড়্গ তো আছেই। ইহার ভিত্তিতে গ্রেফতার করিয়া জেলে পুরিয়া রাখিবার ব্যবস্থা করা হইতেছে যাহাতে নির্বাচনি কার্যক্রম ও প্রচার-প্রচারণায় তাহারা শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করিতে না পারেন। যেহেতু নির্বাচিন তপশিল ঘোষণা হইলে এমনটি করিবার অবকাশ নাই, তাই এখন নির্বাচনপূর্ব এই মোক্ষম সময়টাকে বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। এই পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া কোনো কোনো জেলা-উপজেলায় যদি কুরুক্ষেত্র তৈরি হইয়া যায়, তাহাতে আমরা আশ্চর্যান্বিত হইব না।
অনেকের অভিযোগ, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেন সক্রিয় দলীয় কর্মীবাহিনী বানানো হইয়াছে। ইহার পরিণাম কতটা ভয়ংকর হইতে পারে সেই সম্পর্কে কেহ চিন্তা করিতেছেন বলিয়া প্রতীয়মান হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের বন্ধু, তাহাদের সর্বদা জনস্বার্থে নিয়োজিত হইবার কথা; কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাহাদের উপর চড়াও হইবার ঘটনা কেন ঘটিতেছে? ইহা নাগরিকদের কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না—তাহাও ভাবিয়া দেখা প্রয়োজন।